'নৌকায় ভোট দিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হবে কেন?'

ভাঙচুর করা একটি ঘর। সালথা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর নৌকার সমর্থকদের বাড়িঘরে ভাঙচুর চালানো হয়। বৃহস্পতিবার সকালে সালথার তুগোলদিয়া এলাকায়।  প্রথম আলো
ভাঙচুর করা একটি ঘর। সালথা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর নৌকার সমর্থকদের বাড়িঘরে ভাঙচুর চালানো হয়। বৃহস্পতিবার সকালে সালথার তুগোলদিয়া এলাকায়। প্রথম আলো

‘আমার ভোট আমি যাকে খুশি দেব। নৌকায় ভোট দেওয়ার জন্য পালিয়ে বেড়াতে হবে কেন? বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে মনে একটা বুঝ দিতে পারতাম। নৌকায় ভোট দিয়ে বিপদে পড়ে গেছি।’

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে নিজ বাড়িতে কথাগুলো বলছিলেন ফরিদপুরের সালথা উপজেলার ভাওয়াল ইউনিয়নের তুঘলদিয়া গ্রামের হিন্দু পাড়ার গৃহবধূ পার্বতী দাস। তাঁর অভিযোগ, গত সোমবার রাতে সালথা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর তাঁদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে।

পার্বতীর স্বামী মানিক সিকদার জানান, নির্বাচনের পর থেকে তিনি বাড়ি থেকে বের হননি। যাননি পাশের তুঘলদিয়া বাজারে। সেখানে গেলে মার খেতে হতে পারে, এ ভয়ে একপ্রকার কোণঠাসা হয়ে বাড়িতে পড়ে আছেন। তাঁর ভাই বিপুল সিকদারকে (৩৪) ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছেন আনারস সমর্থকদের রোষানল থেকে বাঁচাতে।

১৮ মার্চ সালথা উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন। তিনি হেরে যান আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মো. ওয়াদুদ মাতুব্বরের কাছে। ওয়াদুদ উপজেলার গট্টি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

হিন্দু পাড়ার ওই কয়েকটি পরিবার ছাড়াও নৌকায় ভোট দেওয়ায় তুঘলদিয়া গ্রামের নৌকার সমর্থকদের অনেকের বাড়িতে ও দোকানে হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। নির্বাচনের দিন সন্ধ্যা থেকেই হামলা শুরু হয়। গত বুধবারও হামলার ঘটনা ঘটেছে।

জমিতে পেঁয়াজ তুলতে গেলে বুধবার সকালে তুলঘলদিয়া পূর্ব পাড়া গ্রামের বেলায়েত মাতুব্বরকে (৩৪) ৫–৬ জন খেতের মধ্যে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে আহত করে। বেলায়েত বর্তমানে পাশের নগরকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি। নির্বাচনের দিন রাতে গ্রামের রফিক মাতুব্বরের (৪৮) বাড়িতে হামলা হয়। হামলাকারীরা বাড়ির টিনের বেড়া ও চেয়ার ভাঙচুর করে। বাড়িতে না থাকায় বেঁচে যান রফিক। সেই থেকে রফিক বাড়িছাড়া। রফিকের স্ত্রী দেলোয়ারা বেগম বলেন, ‘নৌকায় ভোট দেওয়ার জন্য আমাদের ওপর হামলা হয়েছে। বাড়িতে এখন কোনো পুরুষ মানুষ নেই। খেতে পেঁয়াজ পেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তোলার লোক নেই।’

একই দিন হামলা হয়েছে তুঘলদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে অবস্থিত মো. ফরিদ শেখের (৪৮) দোকানে। দোকানটি ভেঙে টিন কুপিয়ে তছনছ করা হয়। লুট করা হয় দোকানের জিনিসপত্র। ফরিদের স্ত্রী আবেকা বেগম বলেন, হামলার দিন থেকে তাঁর স্বামী নিরুদ্দেশ। কোথায় আছেন তিনি জানেন না। সেই দিন থেকে তাঁর জ্বর। বড় কষ্টে দিন কাটছে।

নির্বাচনের দিন হামলা হয়েছে ওমর শেখের বাড়িতে। হামলাকারীরা ওমরের দুটি গরু নিয়ে গেছে। নির্বাচনের পরের দিন রাতে তুঘলদিয়া গ্রমের আলেপ মাতুব্বরের বাড়িতে হামলা হয়। লুটপাট ঠেকাতে গিয়ে আলেপের মেজো বোন ইঙ্গুলি বেগম মারপিটের শিকার হন। ইঙ্গুলি বেগমের ছোট বোন রেখা বেগম বলেন, ‘আমরা একই গ্রামের মানুষ। যারা হামলা করেছে, তাদের সবাইকে আমরা চিনি। কিন্তু নাম বললে আমাদের সর্বনাশ হবে বলে ভয় দেখিয়ে গেছে হামলাকারীরা।’

আলেপ মাতুব্বরের বোন লিপি বেগম বলেন, ‘আমরা এক এলাকার মানুষ। ভোটে একেকজন একেক পক্ষ নেয়। একজন জেতে, অন্যরা হারে। কিন্তু নির্বাচনের পর এ কেমন প্রতিহিংসা। প্রতিবাদ, প্রতিশোধের এই মানসিকতার শেষ হওয়া দরকার। এভাবে কোনো এলাকার রাজনীতি চলতে পারে না।’

আওয়ামী লীগের প্রার্থী দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘দল ক্ষমতায়, সেখানে নৌকার পক্ষে ভোট দেওয়ায় মানুষ হামলার শিকার হচ্ছে, আতঙ্কের মধ্যে আছে। বিষয়টি কল্পনা করে লজ্জায় হেট হয়ে আসে আমার মাথা।’

যোগাযোগ করা হলে ওয়াদুদ মাতুববর ফোন ধরেননি। ওয়াদুদের সমর্থক সালথা উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ওহিদুজ্জামান বলেন, নির্বাচনের পর কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। অনেকে মনের ভয়ে পালিয়ে আছেন। এ অবস্থা বেশি দিন থাকবে না।

সালথা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দেলোয়ার হোসেন বলেন, নির্বাচনের পর বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতির সুযোগে পূর্বশত্রুতা অনেকে চরিতার্থ করে থাকেন। পরিস্থিতি স্বভাবিক করতে তিনি ভদ্রকান্দা ও তুঘলদিয়া এলাকা পরিদর্শন করেছেন। এ–জাতীয় ঘটনা যাতে না ঘটে, সে ব্যাপারে তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে।

তুঘলদিয়া গ্রামটি ভাওয়াল ইউনিয়নে। এ ইউপির সদস্য সুলতান খান জানান, নির্বাচনী সহিংসতা এ গ্রামে হয়নি, যা হয়েছে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। যাঁরা গ্রাম থেকে বাইরে অবস্থান করছেন, তাঁরা মনের ভয়েই গ্রামছাড়া।