শিক্ষায় আনন্দ ফারুকের

ফারুক হোসেন
ফারুক হোসেন

‘বাজে খরচ করব না, দামি কাপড় পরব না। বেতনের চার ভাগের এক ভাগ টাকা গরিব ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার কাজে ব্যয় করব।’ এই শপথ নিয়ে নিরলস কাজ করেছেন প্রত্যন্ত গ্রামে। আর স্বীকৃতি হিসেবে রাষ্ট্রীয় পদক নিয়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে।

তাঁর নাম ফারুক হোসেন (৩২)। বাড়ি দিনাজপুর সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নের কাশিমপুর মালিপুকুর গ্রামে। শুক্র ও শনিবার বাইসাইকেল নিয়ে ছুটে যান গ্রামের গরিব ছাত্রছাত্রীদের কাছে। খাতা-কলম, স্লেট-পেনসিল তুলে দেন তাদের হাতে। গত ১০ বছরে অন্তত দুই হাজার শিক্ষার্থীকে সহায়তা করেছেন তিনি। বাড়িতে দিয়েছেন বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র।

ফারুক হোসেন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএডিসি) ট্রাকচালকের সহকারী পদে কর্মরত। বর্তমানে তাঁর বেতন ১৪ হাজার ৯০০ টাকা। এর ২৫ শতাংশ তিনি খরচ করেন সমাজসেবায়, বিশেষত গরিব ছেলেমেয়েদের শিক্ষার কাজে। বাকি টাকা দিয়ে চলে মা ছনোয়ারা বেগম, স্ত্রী সাবেরা আক্তার ও আড়াই বছরের শিশুপুত্র সাব্বির হোসেনকে নিয়ে তাঁর সংসার।

দিনাজপুর জেলা সদর থেকে সাড়ে চার কিলোমিটার দূরে কাশিমপুর মালিপুকুর গ্রাম। গত ১০ ফেব্রুয়ারি ফারুকের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মাটির একটি জীর্ণ ঘরে থাকে তাঁর পরিবার। স্বজনেরা জানালেন, ফারুকের বাবা মাহবুব হোসেন ২০০৬ সালে মারা যান। তিনি ছিলেন বিএডিসির শ্রমিক। ২০০২ সালে দিনাজপুর বিএডিসিতে শ্রমিক হিসেবে যোগ দেন ফারুকও। সেখানে প্রায় সব শ্রমিক টিপসই দিয়ে মজুরির টাকা তুলতেন। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন ফারুক। সহকর্মী শ্রমিকেরা যাতে স্বাক্ষর দিয়ে টাকা তুলতে পারেন, সে জন্য তাঁদের অক্ষর শেখানো শুরু করেন তিনি। বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে এবং নাশতার পয়সা বাঁচিয়ে তিনি ক্রমান্বয়ে ২০০ টাকার খাতা-কলম কিনে শ্রমিকদের হাতে তুলে দেন। আস্তে আস্তে সবাইকে সাক্ষর করে তোলেন। এ কাজে খুশি হয়ে নরেশ চন্দ্র নামের একজন গাড়িচালক ফারুককে গাড়ি চালানো শেখান। ২০০৭ সালে রাজশাহীর বিএডিসির উপপরিচালকের দপ্তরে অনিয়মিত গাড়িচালক হিসেবে যোগ দেন তিনি। ট্রাকচালকের সহকারী পদে স্থায়ী নিয়োগ পান ওই বছরের ১৬ জুলাই। বদলি হন রংপুর বিএডিসি কার্যালয়ে। তখন থেকে ওই কার্যালয়ের যুগ্ম পরিচালক (বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র) আ ফ ম সাইফুল ইসলামের গাড়ি চালাচ্ছেন।

আর দশজন হয়তো একুটুতে থেমে থাকতেন। কিন্তু ফারুক ব্যতিক্রম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া করে নিজের পায়ে দাঁড়াব। কিন্তু চেরাডাঙ্গী উচ্চবিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার পরে অভাবের কারণে পড়াশোনা আর এগোয়নি। তাই শিক্ষা উপকরণের অভাবে এলাকার যেসব শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, তাদের পাশে দাঁড়াই আমি।’

ফারুক জানান, খাতা-কলম আর জামাকাপড়ের অভাবে কাশিমপুর মাহানপাড়া গ্রামের স্কুলছাত্র নুর ইসলামের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় ২০০৮ সালের জুলাই মাসে। খবর পেয়ে ফারুক তার বাড়িতে যান এবং নুর ইসলামের মায়ের হাতে তিন হাজার টাকা তুলে দেন। নুর ইসলাম এখন দিনাজপুর সরকারি কলেজে অনার্স পড়ছেন।

ওই বছরেরই ডিসেম্বর মাসে ফারুক গ্রামের অভিভাবকদের নিয়ে বৈঠক করেন। সেখানেই তিনি পান–সিগারেট না খেয়ে, দামি কাপড় না পরে সে টাকায় গরিব শিক্ষার্থীদের সহায়তা করবেন বলে জানান। ২০০৯ সালে তিনি বেতনের ২৫ ভাগ জমানো টাকায় ২০ জন শিক্ষার্থীকে খাতা-কলম ও পোশাক কিনে দিয়ে বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। এভাবে এ পর্যন্ত ইউনিয়নের প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থীকে সহায়তা দিয়েছেন বলে জানান ফারুক।

টাকার অভাবে পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল চেরাডাঙ্গী উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র জাহিদ হোসেনের, অষ্টম শ্রেণির আমেনা, সপ্তম শ্রেণির আবদুস ছাত্তারের। কাশিমপুর গ্রামের মিল্লাত হোসেন, ইমন হোসেন, সাকিলা খাতুনও পড়ে দারিদ্র্যের চাপে। টাকার অভাবে আলাদা করে অঙ্ক ও ইংরেজি পড়া সম্ভব হচ্ছিল না চেরাডাঙ্গী উচ্চবিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী মনজুরুল ইসলামের। এসব শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়ান ফারুক।

কাশিমপুর মালিপুকুর গ্রামের সীমা আক্তার যখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী, তখন বাবা ছামিরুল ইসলাম নিরুদ্দেশ হন। মাস তিনেক পর সীমার বিয়ে ঠিক করেন মা। ফারুক ছুটে গিয়ে সীমার পড়াশোনার দায়িত্ব নিলে তার বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়। সীমা এখন সিকদারগঞ্জ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। সীমা আক্তার প্রথম আলোকে বলল, ‘ফারুক আঙ্কেল আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন। আমি ডাক্তার হতে চাই।’

সিকদারগঞ্জ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী মর্জিনা খাতুন ও সুলতানা খাতুনের প্রতিও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন ফারুক। সিকদারগঞ্জ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে গেলে তানজিলা খাতুন নামের এক শিক্ষার্থী তাঁর স্কুলব্যাগটি দেখিয়ে বলল, ‘ফারুক আঙ্কেল কিনে দিয়েছেন। তিনি আমাকে প্রাইভেট পড়ার টাকাও দিচ্ছেন।’

ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেন বলেন, ‘ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর ভেতরেও যে অপার সম্ভাবনা আছে, তা ফারুক আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন। গ্রামকে মাদকমুক্ত রাখা, পরিবেশ রক্ষায় গাছ লাগানো, সড়কে নিরাপদে চলতে সচেতনতা সৃষ্টির মতো কাজও করছেন ফারুক।’

কাশিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জালাল উদ্দিন বললেন, ‘ফারুক মাসে অন্তত দুবার খাতা-কলম, পেনসিল ও শিশু শিক্ষার বই বাইসাইকেলে নিয়ে স্কুলে স্কুলে গিয়ে বিতরণ করেন। কোনো শিক্ষার্থী স্কুলে অনুপস্থিত থাকলে তার বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নেন। এ কারণে কাশিমপুর গ্রামের শতভাগ শিশু এখন স্কুলে আসে।’

অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় মৌসুমি খাতুনের বিয়ে হয়। শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাঁকে আর পড়াতে চাননি। খবর পেয়ে ফারুক গিয়ে পরিবারের লোকজনকে রাজি করান। দায়িত্ব নেন মৌসুমির পড়ালেখার। মৌসুমি বলেন, ‘ফারুক চাচার কারণে আমার মতো অনেক মেয়ের পড়াশোনার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। আমি এখন কলেজে পড়ছি।’

আউলিয়াপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক, সদস্য মাহাবুব আলমের চোখে ফারুক একজন সমাজসেবক। ১৩ মার্চ আসলে সেই স্বীকৃতিই পেয়েছেন ফারুক। জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ উপলক্ষে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন তাঁর হাতে দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যোৎসাহী সমাজকর্মী পদক–২০১৮ তুলে দেন।

বাড়িতে বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র
ফারুকের বাড়ির উঠানে তাঁর স্ত্রী সাবেরা আক্তার গ্রামের বয়স্ক নারীদের লেখা শেখাচ্ছেন। আর ফারুক কয়েকজন নারীকে নিয়ে বৈঠক করছেন।
বৈঠকস্থল থেকে ৩-৪ হাত দূরে একটি বাইসাইকেল। তার সামনে–পেছনে ঝোলানো কাগজে লেখা সচেতনতামূলক কয়েকটি স্লোগান। সেগুলো হলো ‘খেলাধুলায় বাড়ে বল, মাদক ছেড়ে স্কুলে চল’। ‘রাস্তায় চলতে মনোযোগ রাখব, নিরাপদে বাড়ি ফিরব’। ‘যে মুখে ডাকি মা, সে মুখে মাদক না’। ‘বাল্যবিবাহ দিব না, বিপদ ডেকে আনব না’।

২০১০ সালে ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গি উপজেলার বোয়ালধর গ্রামের সলিমুল্লাহর মেয়ে সাবেরা আক্তারকে বিয়ে করেন তিনি। তখন তিনি নবম শ্রেণিতে পড়তেন। সাবেরা আক্তার আমাদের দিনাজপুর প্রতিনিধিকে বলেন, ‘তাঁর (ফারুকের) আগ্রহের কারণেই আবার পড়াশোনা শুরু করি। ২০১১ সালে দিনাজপুর কেবিএম কলেজে কৃষি ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হই। কৃষি ডিপ্লোমা পাস করে এখন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কৃষিশিক্ষায় স্নাতক (বিএজিএড) করছি। ’

গ্রামের শিরিন আক্তার বলেন, বয়স্ক কেন্দ্রে এসে এখন তিনি নাম-ঠিকানা লিখতে পারেন। বললেন, ‘গ্রামত এমন কাহো নাই যে নাম সহি করতে পারে না। ফারুকের বাড়িত আসিয়া ওর বউয়েরঠেনা সবাই পড়ালেখা শিখিছে।’

সাবেরা বলেন, ‘ভালো কাপড়, ভালো খাবার দিতে না পারলেও ফারুকের কারণে আমরা সমাজে মাথা উঁচু করে চলছি।’

রাষ্ট্রীয় সম্মাননাপ্রাপ্তি সম্পর্কে ফারুক হোসেন বলেন, ‘পুরস্কারের আশায় এই কাজ করিনি। আমার এলাকার কেউ যেন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়, সেই চিন্তা থেকে কাজটি করেছি। ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা শূন্যের কোঠায় না আসা পর্যন্ত এই উদ্যোগ চলবে।’