পুলিশে ধরনা দিয়েও বাঁচতে পারেননি খাদিজা

খাদিজা আক্তার
খাদিজা আক্তার

কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে রায়হান। ১৩ দিনে একবারও মায়ের কাছে যেতে পারেনি দেড় বছরের শিশুটি। বারবার শুধু নানাবাড়ির পাশের সড়কটিতে যেতে চেয়েছে। ‘মা, মা’ বলে বিড়বিড় করেছে। এই সড়ক ধরেই ১২ মার্চ মুমূর্ষু অবস্থায় মা খাদিজা আক্তারকে শেষবার হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেখেছিল সে।

২৪ মার্চ রাত সোয়া ১০টায় যখন রায়হানের ঘুম ভাঙে, তখন বাড়ির পাশের সেই সড়কেই ছিলেন তার মা খাদিজা। ১৩ দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। তবু রায়হানকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন না কেউ। নির্যাতনে থেঁতলে দেওয়া খাদিজার মুখটার দিকে আর তাকানো যাচ্ছিল না। মায়ের এই মুখ ছোট্ট শিশুটি দেখবে কীভাবে। কিছুটা দূরে রায়হানকে বুকে ধরে বিলাপ করছিলেন খাদিজার বোন রুনা।

লাশ নিয়ে আসার আগে নারায়ণগঞ্জ সদর থানার জিমখানা কলোনিতে কথা হয় খাদিজার বড় বোন ফজিলতের সঙ্গে। বলেছিলেন, বিয়ের পর থেকে গত চার বছরে অসংখ্যবার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন খাদিজা। কখনোই পুলিশের কাছে যাননি। অন্য নারীর সঙ্গে স্বামীর সম্পর্কেও বাধা দেননি। উল্টো শাশুড়ির চাহিদা অনুযায়ী আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে প্রায় তিন লাখ টাকার আসবাব ও টাকা নিয়ে গেছেন বিভিন্ন সময়ে। মায়ের কাছে যখনই খাদিজা যেতেন, তাঁর শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখে পরিবার বুঝে নিত যৌতুক নিয়েও ভালো নেই মেয়েটি।

পরিবারের ধারণা ছিল, খাদিজার সন্তান হলে সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। ১০ মার্চ সেই সন্তানকেই মারধর করেন স্বামী ফরহাদ হোসেন ও শাশুড়ি। এ নিয়ে ১১ মার্চ ফতুল্লা থানায় শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন খাদিজা। ১১ মার্চ রাতেই খাদিজার সঙ্গে ফতুল্লার কাশিপুর এলাকায় তাঁর শ্বশুরবাড়িতে যান ফতুল্লা থানার এসআই মামুন উল আবেদ। খাদিজার শ্বশুরের কাছ থেকে তিন হাজার টাকা নিয়ে তাঁদের মধ্যে মীমাংসা করে দেন। এরপরই খাদিজাকে শাসিয়ে ফরহাদ হোসেন বলেছিলেন, পুলিশ দিয়ে তাঁর কিছুই করা যাবে না। উল্টো খাদিজাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন শ্বশুর ইয়ার হোসেন ভুট্টু। এসব ঘটনা মুঠোফোনে মা আর বোনকে জানিয়েছিলেন খাদিজা।

১১ মার্চের পর ২৩ মার্চ থানায় আরও একটি অভিযোগ করেছিলেন খাদিজার খালু ফারুক আহমেদ। সেই অভিযোগ মামলায় রূপ নেওয়ার আগেই চিকিৎসাধীন খাদিজা মারা যান। খাদিজার স্বজনদের ক্ষোভ, অভিযোগের ১৪ দিন পার হলেও অভিযুক্ত কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ।

চার বছর আগে স্বামীর মৃত্যুর পর দুর্ঘটনায় এক পা অচল হয়ে যায় খাদিজার মা নূর জাহানের। ষাটোর্ধ্ব এই বৃদ্ধা জিমখানা রেলওয়ে কলোনির একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। ১২ মার্চ সকালে যখন ফরহাদের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেন, তখনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কিছু একটা হয়েছে। মেয়ের বাড়িতে ছুটে যান। সেখানে পৌঁছানোর আগেই আশপাশের মানুষ তাঁকে বলেছে, সকালেই খাদিজার চিৎকার শুনেছেন তাঁরা।

মুমূর্ষু খাদিজাকে ভর্তি না করে ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়ে দেন চিকিৎসকেরা। সেখানেই টানা ১৩ দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকদের কাছে রুনা শুনেছেন, রশি দিয়ে গলায় ফাঁস দেওয়া হয়েছিল খাদিজার। মৃত্যু নিশ্চিত করতে বিষাক্ত কিছু খাওয়ানো হয়েছিল। ভারী কিছু দিয়ে থেঁতলে দেওয়া হয়েছিল মুখ। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক প্রদীপ বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, খাদিজার শরীরে নির্যাতনের বেশ কিছু চিহ্ন ছিল।

মৃত্যুর পর ফতুল্লা মডেল থানায় খাদিজার স্বামী, শাশুড়িসহ চারজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন তাঁর খালু ফারুক আহমেদ। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মঞ্জুর কাদের বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। এসআই মামুন উল আবেদ বলেন, ‘আমি গরিব লোকদের কাছ থেকে কখনোই টাকা নিই না। এটা আমার পার্সোনালিটি।’ অভিযুক্ত ফরহাদের মুঠোফোন বন্ধ পেয়ে তাঁর বড় ভাই রাব্বি মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাঁর মা এবং ভাই মিলে মেয়েটিকে মারধর করতেন—এমনটা আগেও শুনেছেন তিনি।