ফজলুর রহমান খানের শেষ আকুতি

ফজলুর রহমান খান
ফজলুর রহমান খান

‘জবান, শিরীনের সঙ্গে আমার আর এ জীবনে দেখা হলো না।’ সেই গণহত্যার রাতে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর গৃহকর্মী জবান আলীকে বারবার একটি কথাই বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফজলুর রহমান খান। নিজে শেষবারের মতো চোখ বোজার আগে এই তরুণ শিক্ষক স্মরণ করছিলেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী ফরিদা রউফ খান শিরীনকে। তাঁর স্ত্রী সেই সময় ছিলেন তাঁর থেকে অনেক দূরে—ইংল্যান্ডে পিএইচডি গবেষণার কাজে ব্যস্ত। শিরীনের সঙ্গে দেখা হলো না, এই আকুতি নিয়েই ফজলুর রহমান খান ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে।

১৯৭১ সাল। ২৫ মার্চের কালরাত শেষ হয় হয়। ঢাকা শহরজুড়ে পাকিস্তানি বাহিনী একের পর এক চালিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসযজ্ঞ এবং হত্যার অমানবিক লীলা। তাদের আক্রমণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ২৫ মার্চের কালরাত শেষে দিনপঞ্জিতে যখন ফুটে উঠেছে ২৬ মার্চের আভা, এ সময় ইকবাল হলের (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) পাশের আবাসিক শিক্ষক ভবনের তিনতলার পূর্ব দিকের ২৩ এফ ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ঘাতকেরা। অকথ্য গালাগালি করে সবাইকে বেরিয়ে আসতে বলল তারা। এই ফ্ল্যাটের কর্তা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ফজলুর রহমান খান ভাবলেন, হাত উঁচু করে বেরিয়ে এলে কাউকে কিছু করবে না পাকিস্তানিরা। শোবার ঘরের সামনে তাঁরা বেরিয়ে এলেন—ফজলুর রহমান খান, তাঁর ভাগনে কাঞ্চন ও গৃহকর্মী জবান আলী। এরপর ঘাতকের বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেল তিনজনের বুক। সেদিন গুলি খাওয়ার পরও বেঁচে গিয়েছিলেন জবান আলী। পরবর্তীকালে তাঁর কাছ থেকেই জানা যায় ফজলুর রহমান খানের হত্যাযজ্ঞের কাহিনি। সেই কাহিনি সবিস্তারে লেখা আছে আলী মো. আবু নাঈম ও ফাহিমা কানিজ লাভা সম্পাদিত শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থে। এই বইয়ের সূত্রে জানা যায় ফজলুর রহমান খান সম্বন্ধে অনেক তথ্যও।

তাঁর জন্ম ১৯৩৯ সালের ২ মার্চ, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার কাজিয়াটি গ্রামে। স্কুলজীবনে অংশ নিয়েছিলেন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে। ১৯৫৪-তে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করলেন এসএসসি। ’৫৮-তে এইচএসসি। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়ে ’৬০-এ বিএসসি এবং ’৬২-তে এমএসসি সম্পন্ন করার পর একই বিভাগে যোগ দেন প্রভাষক হিসেবে।

এরপর লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে পিএইচডি শেষে ১৯৬৮-এর ১ আগস্ট দেশে ফেরার পর ফরিদা রউফ খান শিরীনের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। তাঁদের একটা মেয়ে হয়। তবে ১৪ দিনের মাথায় মারা যায় মেয়েটি।

নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের শহীদ বুদ্ধিজীবী ফজলুর রহমান খানসহ আরও দুই শহীদ স্মরণে এই ফেব্রুয়ারিতে মোহনগঞ্জ সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভের ফলক উন্মোচন করা হয়েছে।

সম্প্রতি ফজলুর রহমান খানের ভাইয়ের মেয়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুনিরা নাসরীন খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘চাচা বেঁচে থাকলে দেশের জন্য অনেক কাজ করতে পারতেন। আমাদের সবার জীবনই অন্য রকম হতো। বিশেষত, আমার চাচিকে একাকী জীবন কাটাতে হতো না। চাচার মৃত্যুর পর চাচি আর পিএইচডি সম্পন্ন করেননি। এখনো চাচার স্মৃতি বুকে নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি।’