বিচারের কাঠগড়ায় হেনরি কিসিঞ্জার

হেনরি কিসিঞ্জার
হেনরি কিসিঞ্জার

এখন তাঁর বয়স ৯৫। বয়সের ভারে কিছুটা নুয়ে পড়েছেন, হাঁটাচলা শ্লথ হয়ে এসেছে, কিন্তু স্মৃতি এখনো টনটনে। এখনো বই লিখছেন, মোটা অর্থের বিনিময়ে ভাষণ দিচ্ছেন, মাঝেমধ্যে হোয়াইট হাউসে এসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে যাচ্ছেন। বার্ধক্য, স্মৃতিবিভ্রাট অথবা বাতুলতা—কোনো যুক্তিই তাঁর ক্ষেত্রে খাটে না। তাঁকে অবশ্যই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়।

ব্রিটিশ লেখক ক্রিস্টোফার হিচেনস প্রায় এক যুগ আগে হেনরি কিসিঞ্জারের বিচার—এই নামের একটি গ্রন্থে কোন অপরাধে এই বিচার, তার একটি তালিকা দিয়ে গেছেন। সব অপরাধ নয়, যেসব অপরাধের প্রমাণযোগ্য নথিপত্র রয়েছে, তিনি কেবল সেসবই তালিকাভুক্ত করেছেন। তালিকাটি সংক্ষেপে এ রকম:

১. ষাট ও সত্তর দশকে ইন্দোচীনে নিরপরাধ নাগরিকদের সুপরিকল্পিত হত্যায় মদদ।

২. ১৯৭১-এ বাংলাদেশের গণহত্যায় সমর্থন ও সাহায্য।

৩. ১৯৭৩-এ চিলির সামরিক অভ্যুত্থান ও বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন।

৪. সাইপ্রাসের আর্চবিশপ ম্যাকারিয়সের হত্যা পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ।

৫. পূর্ব তিমুরে ইন্দোনেশীয় সেনাবাহিনীর হাতে গণহত্যায় সাহায্যদান।

ষাট ও সত্তর দশকে দীর্ঘ সময় কিসিঞ্জার একাধিক মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন—কখনো জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, কখনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে। আমি কেবল প্রেসিডেন্টের নির্দেশ পালন করেছি, এমন খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে তিনি পার পাবেন না। কারণ, এমন নথিপত্র এখন অবমুক্ত হয়েছে যাতে স্পষ্ট অন্য কেউ নয়, অধিকাংশ অপরাধের পেছনে রয়েছে তাঁর কলমের দাগ। যেমন প্রমাণ রয়েছে বাংলাদেশের গণহত্যায় তাঁর ভূমিকার। এই আলোচনায় আমরা কেবল সেদিকেই দৃষ্টি দেব।

১৯৭১-এর ২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যা শুরু হয়েছে, এই তথ্য কিসিঞ্জারের অজানা ছিল না। তখন তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা প্রশ্নে সহকারী। উইলিয়াম রজার্স পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেও পররাষ্ট্রবিষয়ক অধিকাংশ প্রশ্নে তিনিই ছিলেন নিক্সনের মন্ত্রণাদাতা। ২৮ মার্চ ঢাকায় মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড এক টেলিগ্রামে হোয়াইট হাউসকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ‘ভীতির রাজত্ব’ কায়েম হয়েছে বলে যে সতর্কবার্তা প্রেরণ করেন, পরদিন সকালেই সে তথ্য তাঁর কাছে পৌঁছে যায়। একদিন পর দিল্লিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিটিং ‘নির্বাচিত গণহত্যা’ এই শিরোনামে এক টেলিগ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সরবরাহকৃত অস্ত্র দিয়ে নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে জড়িত, একথা জানিয়ে অনুরোধ রাখলেন, ‘নীতির ভিত্তিতে কর্মপন্থা নির্ধারণের এখনই সময়’। এক সপ্তাহ পর, ৬ এপ্রিল, ঢাকা থেকে ২১ জন মার্কিন কূটনীতিক এক যৌথ টেলিগ্রামে বাংলাদেশে গণহত্যায় মার্কিন নীরবতায় তাঁদের ‘ভিন্নমত’ জানিয়ে এক কঠোর বার্তা পাঠালেন। স্বাক্ষরকারীদের একজন ছিলেন আর্চার ব্লাড।

বাঙালিদের নয়, তাঁরা পাকিস্তানের পক্ষেই থাকবেন—নিক্সন ও কিসিঞ্জার এ সিদ্ধান্ত এক বছর আগেই নিয়ে রেখেছিলেন। ২৫ অক্টোবর ১৯৭০ সালে হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে ইয়াহিয়ার সঙ্গে মুখোমুখি বৈঠকেই সে সিদ্ধান্ত তাঁরা নেন। ‘আপনাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব’—নিক্সন তাঁকে জানিয়েছিলেন। জবাবে ইয়াহিয়া বলেছিলেন, ‘আপনাদের বন্ধুত্বের জন্য আমরা গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। কথা দিচ্ছি, এমন কিছুই করব না যাতে আপনারা বিব্রত হন।’

পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে, সেনা মোতায়েন হচ্ছে, একথা কিসিঞ্জার খুব ভালো করেই জানতেন। ১৩ মার্চ নিক্সনের কাছে এক মেমোতে তিনি পরামর্শ দিলেন, এখন এমন কিছুই আমরা করব না যা ইয়াহিয়া আপত্তিজনক মনে করে। পাকিস্তানের ঐক্যের স্বার্থে আমাদের উচিত ইয়াহিয়ার সঙ্গে থাকা।

ঢাকা থেকে সামরিক অভিযানের খবর পেয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার বদলে খুশিই হলেন কিসিঞ্জার। ২৯ মার্চ তিনি নিক্সনকে জানালেন, মনে হয় ইয়াহিয়ার গৃহীত ব্যবস্থায় কাজ হয়েছে। ‘পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা এখন ইয়াহিয়ার নিয়ন্ত্রণে।’ সেকথা শুনে নিক্সনের জবাব ছিল, ‘চমৎকার। মাঝেমধ্যে শক্তির ব্যবহার কাজে লাগে।’ সে কথায় মাথা নাড়লেন কিসিঞ্জার। ইতিমধ্যে ঢাকায় পাকিস্তানিদের হাতে গণহত্যার খবর পত্রপত্রিকার প্রকাশিত হয়েছে। ব্লাড টেলিগ্রামও নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ফাঁস হয়েছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নিক্সন প্রশাসনের ওপর প্রবল চাপ বাড়ছিল। কিন্তু কিসিঞ্জার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি কথা বলতেও প্রস্তুত ছিলেন না। ১৯ এপ্রিল এক মেমোতে তিনি লিখলেন, পাকিস্তানের প্রতি সাহায্য বন্ধের যে দাবি উঠেছে, তিনি তার বিরুদ্ধে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের ভেতরেই তাঁর কথার প্রতিবাদ উঠল, নৈতিক কারণে হলেও পূর্ব পাকিস্তানে হত্যাকাণ্ড বন্ধে ইয়াহিয়াকে উৎসাহ দেওয়ার দাবি করলেন বিভাগীয় কর্মকর্তারা। সব বাতিল করে দিলেন কিসিঞ্জার। নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে তাঁর যুক্তি ছিল, এর ফলে ভারতকে সাহায্য করা হবে। সে কথার সমালোচনা হলে কিসিঞ্জার নতুন পথ ধরলেন। এই নীতি আমার নয়, প্রেসিডেন্টের। তিনি জানালেন, পাকিস্তান, বিশেষত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার জন্য নিক্সনের ‘কিছুটা দুর্বলতা রয়েছে’।

পরে, নিজের স্মৃতিকথায় নিক্সন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পেশাদার কূটনীতিকদের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাঁর কথায়, এখন যারা পূর্ব পাকিস্তানের মৃত মানুষদের জন্য মায়াকান্না দেখাচ্ছে, তারা আসলে ভিয়েতনামে মার্কিন স্বার্থ ক্ষুণ্ন করতে সবকিছু করতেই প্রস্তুত ছিল। (ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসন সে সময় এক জটিল পর্যায়ে পৌঁছেছে।) এই ‘মায়াকান্না’র জন্য যাদের চড়া মূল্য দিতে হয়, তাদের একজন হলেন আর্চার ব্লাড। তাঁকে কূটনৈতিক দায়িত্ব থেকে সরিয়ে মামুলি আমলাতান্ত্রিক কাজ দেওয়া হয়, তাঁর পদোন্নতি আটকে দেওয়া হয়।

পাকিস্তানের প্রতি এই দুর্বলতা কেন, পাকিস্তানের সামরিক শাসকের সঙ্গে ‘কী বিশেষ সম্পর্ক’, সে কথা তখনো অনেকের অজানা। জুলাই মাসের মাঝামাঝি জানা গেল, পাকিস্তানের সামরিক শাসকের মধ্যস্ততায় চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চলছে। নিজের স্মৃতিকথায় কিসিঞ্জার যুক্তি দেখিয়েছেন, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন আমেরিকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আর সে সম্পর্ক স্থাপনে ‘একমাত্র’ সূত্র ছিল পাকিস্তানের ইয়াহিয়া। কথাটা মিথ্যা। সে সময় স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা ছিলেন ক্রিস্টোফার ভ্যান হলেন। পরে এক দীর্ঘ প্রবন্ধে তিনি প্রমাণ করেছেন, শুধু ইয়াহিয়া নয়, রুমানিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান চাউশেস্কু, ইরানের শাহ এবং পোল্যান্ডের মাধ্যমে সে যোগাযোগের সুযোগ ছিল। বস্তুত, ইয়াহিয়ার আগে চাউশেস্কুর মাধ্যমে চীনা নেতাদের সম্মতিসূচক চিঠি এসে পৌঁছেছিল।

ভ্যান হলেন লিখেছেন, কিসিঞ্জার পিকিং ঘুরে এসেছেন এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, এই ঘোষণার পর স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন, পাকিস্তানের প্রয়োজন ফুরিয়েছে, এবার হয়তো আমেরিকা পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যার ব্যাপারে নীতি বদলাবে। কিসিঞ্জার তাতেও আপত্তি করেন। এবার তাঁর নতুন মন্ত্র হলো, ভারত শুধু পূর্ব পাকিস্তানের বিভক্তি নয়, সে পাকিস্তান আক্রমণ করে সে দেশ দখল করতে চায়। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে এ ব্যাপারে ইন্ধন জোগাচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ভ্যান হলেন জানাচ্ছেন, সিআইএ এবং অন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কেউই এই তথ্য দেয়নি, ভারত পাকিস্তান দখলে উদ্যত এমন কোনো কথা কোনো পক্ষ থেকেই বলা হয়নি।

৩১ জুলাই জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সভায় দাবি উঠল, ইয়াহিয়াকে বলা হোক তিনি যেন পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক দায়দায়িত্ব থেকে সেনাবাহিনী সরিয়ে আনেন। সে কথা শুনে খেপে উঠলেন কিসিঞ্জার। ‘ইয়াহিয়া কীভাবে দেশ চালাবেন, তা নিয়ে আমাদের এত মাথাব্যথা কেন?’ তিনি প্রশ্ন করলেন। সেই সভাতেই কিসিঞ্জার জানালেন, আমেরিকার নীতি যাতে পাকিস্তানের পক্ষে থাকে, নিক্সন তাঁকে সে ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন।

ডিসেম্বরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে সিআইএ জানায়, ভারত আজাদ কাশ্মীর দখলে বদ্ধপরিকর। কিসিঞ্জার সেই প্রতিবেদনকেই ভারতের পাকিস্তান দখলের অকাট্য প্রমাণ বলে ধরে নেন। যেকোনো মূল্যে পাকিস্তানকে রক্ষা করতে হবে—এই বিবেচনা থেকে তিনি চীনকে চাপ দিতে শুরু করলেন, যাতে ভারতের পশ্চিম সীমান্তে সে সৈন্য মোতায়েন করে। নিউইয়র্কে এক গোপন বৈঠকে কিসিঞ্জার চীনা রাষ্ট্রদূত হুয়াং হুয়াকে অনুরোধ করলেন, সরাসরি যুদ্ধ শুরু করতে হবে না। শুধু সীমান্তে চীনা সৈন্য মোতায়েন করলেই ভারত ভয় পেয়ে আত্মরক্ষার খাতিরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সৈন্য সরিয়ে আনতে বাধ্য হবে। এর ফলে ইয়াহিয়ার ওপর চাপ কমবে।

তারপরেও চীন ও ভারতের মধ্যে যদি সামরিক সংঘর্ষ বেধেই যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র চীনের পাশে থাকবে, হুয়াকে প্রতিশ্রুতি দিলেন কিসিঞ্জার। পরে, এক সাক্ষাৎকারে নিক্সন স্বীকার করেন, ১৯৭১-এ যদি চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষ শুরু হতো, তাহলে তিনি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে দ্বিধা করতেন না। পরবর্তীকালে অবমুক্ত ‘নিক্সন টেপ’-এ তাঁদের দুজনের এই রকম এক কথোপকথন রেকর্ডে ধরা আছে:

কিসিঞ্জার: সোভিয়েতরা যদি চীনের বিরুদ্ধে হামলা চালায় আর আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকি, তাহলে আমাদের মহা সর্বনাশ হবে (কোথাও কোনো সম্মান থাকবে না)।

নিক্সন: তাহলে কী করব, সোভিয়েতদের উদ্দেশে পারমাণবিক অস্ত্র ছোড়া শুরু করব?

কিসিঞ্জারের কথায়, সেটিই হবে চূড়ান্ত খেলা, ফাইনাল শোডাউন। তিনি এমন যুক্তিও দেখালেন, ‘পাকিস্তানের বলাৎকার’ ঠেকাতে অন্য কোনো পথ আমাদের জন্য খোলা নেই। ‘আমাদের ও চীনের এক বন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়নের এক বন্ধুর সঙ্গে বিবাদে ঠকে যাবে, তা তো হতে দিতে পারি না।’

পাকিস্তানের সমর্থনে কিসিঞ্জার আরও একটি ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিলেন। তিনি জর্ডান ও ইরানের মাধ্যমে পাকিস্তানকে মার্কিন যুদ্ধবিমান সরবরাহে সম্মত হলেন। মার্কিন কংগ্রেস আগেই পাকিস্তানকে কোনো অস্ত্র সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। সে কথা অগ্রাহ্য করে কিসিঞ্জারের পরামর্শে নিক্সন জর্ডানের মাধ্যমে যুদ্ধবিমান ব্যবহারের নির্দেশ দিলেন। ব্যাপারটা বেআইনি, খবরটা জানাজানি হলে তিনি বিপদে পড়বেন, সে কারণে নিক্সন কিছুটা দ্বিধায় ছিলেন। কিসিঞ্জার তাঁকে আশ্বাস দিলেন, ‘যদি এই তথ্য ফাঁস হয়, তো আমরা সাফ অস্বীকার করব।’

ভারতীয় বাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর যৌথ আক্রমণের মুখে দীর্ঘ সময় পাকিস্তানি সেনারা টিকে থাকতে পারবে না, একথা কিসিঞ্জার ও নিক্সনের অজ্ঞাত ছিল না। শেষ চেষ্টা হিসেবে তাঁরা বঙ্গোপসাগরে ভারত-বাংলাদেশ নৌসীমানায় আণবিক অস্ত্র সজ্জিত সপ্তম নৌবহর পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।

কোনো ব্যবস্থাই কাজে লাগেনি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইয়াহিয়া-কিসিঞ্জার-নিক্সন ঠেকাতে পারেননি। কিসিঞ্জার পরে তাঁর হোয়াইট হাউস ইয়ার্স গ্রন্থে সাফাই গেয়েছেন, তাঁর জন্যই (পশ্চিম) পাকিস্তানকে বাঁচানো গেছে। বাংলাদেশের গণহত্যায় তিনি বাধা দেননি, কিন্তু ‘সবই করতে হয়েছিল পাকিস্তানকে বাঁচাতে’।

মিথ্যা সাফাই গেয়ে নিজের অপরাধকে ঢাকতে পারবেন না কিসিঞ্জার। তিনি ও তাঁর পরিবার হিটলারের ইহুদি নিধনযজ্ঞের শিকার, উদ্বাস্তু হিসেবে আমেরিকায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই তিনি ইন্দোচীন থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত একের পর এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞের প্রধান মন্ত্রণাদাতা হয়ে ওঠেন। তিনি নিজ হাতে কাউকে হত্যা করেননি, সে যুক্তি ধোপে টেকে না, যেমন ধোপে টেকেনি ইহুদি হত্যায় অভিযুক্ত আইখম্যানের ক্ষেত্রে। জন এন্ডারসন লি বলেছেন, কিসিঞ্জার একজন ‘নিষ্ঠুর চিয়ারলিডার’ বা হাততালিওয়ালা। তাঁরই পরামর্শে হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা হচ্ছে, সীমানার বাইরে বসে তিনি ডুগডুগি বাজিয়ে সেই হত্যাকাণ্ড দেখেছেন। সেইমোর হার্শ লিখেছেন, নিজের ক্ষমতা ব্যবহারে অন্ধ ছিলেন কিসিঞ্জার। হিচেন্স বলেছেন আরও শক্ত কথা। ‘কিসিঞ্জার হলেন ক্ষমতার পর্নোগ্রাফির এক প্রতীক’। পাকিস্তান রক্ষা নয়, তাঁর আসল লক্ষ্য ছিল নিক্সনের পুনর্নির্বাচন নিশ্চিত করা এবং নিজের জন্য ইতিহাসে নাম কেনা।

একাত্তরের গণহত্যা আর এরপর ৪৮ বছর কেটে গেছে। বিচারের কাঠগড়ায় উঠতে হয়নি কিসিঞ্জারকে, কিন্তু বিশ্বের বিবেকবান মানুষের ঘৃণা ও বিদ্রূপ আমৃত্যু তাঁকে আঘাত করবে। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্ত।