মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বড় কাজ ও গবেষণা নেই

>
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়

*১০ বছর টানা ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ সরকার
*সংজ্ঞা, তালিকা, সংখ্যা নিয়ে তৎপর মন্ত্রণালয়
*মন্ত্রণালয় মূল কাজটি ঠিকমতো করেনি অভিযোগ
*সীমাবদ্ধতার কথা বলছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী

দেড় যুগ আগে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে কোনো দলিল বা ইতিহাসবিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশ করেনি মন্ত্রণালয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরার জন্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে কোনো গবেষণা হয়নি। নেই কোনো গণগ্রন্থাগার ও আর্কাইভ। মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে সম্মানী ভাতাসহ বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হলেও তার স্বচ্ছতা ও তদারকি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

গত ১০ বছর টানা ক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু পুরো সময়ে মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, সংখ্যা ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা যাচাই–বাছাইয়ের কাজে বেশি তৎপর থেকেছে মন্ত্রণালয়।

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের মতে, তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতেই এই মন্ত্রণালয়ের জন্ম। কিন্তু মন্ত্রণালয় তাদের মূল কাজটি ঠিকমতো করেনি, বেসরকারিভাবে যারা গবেষণা করছে, তাদেরও তেমন সহায়তা দেয়নি। মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই, দলিল, সে সময়ের পত্রপত্রিকা, মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট, তথ্যচিত্র, ভিডিও ফুটেজ, চলচ্চিত্র, অডিও ও আলোকচিত্র নিয়ে একটি গ্রন্থাগার ও আর্কাইভ করার পরামর্শ দেন তাঁরা।

জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সীমাবদ্ধতা ছিল, আছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে আমরা নানা উদ্যোগ নিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠ বাধ্যতামূলক করতে মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে।’ মন্ত্রী বলেন, রাজাকার-আলবদরদের একটি তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার কাজটিও এ মেয়াদেই শেষ হবে।

২০০১ সালের ২৩ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যাত্রা শুরু। মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজের মধ্যে রয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধা, সংগঠক, শিল্পী–সাহিত্যিক ও সংশ্লিষ্টদের সঠিক তালিকা তৈরি ও হালনাগাদ, যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস, মুজিবনগর দিবস, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, বিজয় দিবস উদ্যাপন, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা, যুদ্ধাহত ও খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের চিকিৎসা, রেশনসহ বিভিন্ন সুবিধা প্রদান, মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসভিত্তিক দলিল প্রকাশ ও সংরক্ষণ, মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান, যুদ্ধক্ষেত্র, বধ্যভূমি ও গণকবর চিহ্নিত করে সংরক্ষণ, মুক্তিযুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য দেশি–বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক মেজর (অব.) এ এস এম শামসুল আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোনো গবেষণা না হওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক। স্বাধীনতার ৪৮ বছরে সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে কোনো ‘প্রতিষ্ঠান’ও গড়ে তুলতে পারেনি। গুরুত্বপূর্ণ কোনো দলিল বা কাগজপত্র সংগ্রহ নেই মন্ত্রণালয়ের। এখনো জাতীয়ভাবে পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরার বিষয়টি বাস্তবায়ন হয়নি। বড় কোনো গবেষণা হয়নি, যা রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যায়। অথচ সরকারের জন্য এ কাজগুলো তেমন কঠিন নয়। সরকারের উচিত স্বাধীনতার দলিল তৈরিতে কাজ শুরু করা।

তবে বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে কাজ করছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি মফিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, গবেষণায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিজেদের কোনো বড় কাজ নেই, তবে তারা সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। মন্ত্রণালয়ের উচিত শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে সঙ্গে নিয়ে কাজ করা। প্রয়োজনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিয়েও গবেষণা শুরু করা যায় বলে তিনি মনে করেন।

কবি ও সাংবাদিক হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ১৬ খণ্ডের বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র (১৯৮২-৮৩) এখন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম তথ্যভিত্তিক গ্রন্থ। পরে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: দলিল ও ইতিহাসবিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশ’ প্রকল্প নেওয়া হয়। আদালতের নির্দেশে বাতিল ও বাজেয়াপ্ত করা হয় ওই প্রকল্পের সবচেয়ে বড় কাজ স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ সমুন্নত রেখে কাজ করার প্রত্যয় নিয়ে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। দায়িত্ব নেওয়ার পর তৃণমূল পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল সংরক্ষণ ও উন্নয়ন প্রকল্প, মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থানগুলো সংরক্ষণ ও স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ, ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতাস্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়), নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধকরণ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্থাপনাগুলো সংরক্ষণ ও পুনর্নির্মাণ এবং মুক্তিযুদ্ধকালে শহীদ মিত্রবাহিনীর সদস্যদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে ছয়টি প্রকল্প নেওয়া হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক মুনতাসীর মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ছড়িয়ে দিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়নি মন্ত্রণালয়। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে একটি আর্কাইভ করার অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু আমাদের প্রস্তাব আমলে নেয়নি।’ তিনি বলেন, ওই মন্ত্রণালয়ে যাদের ন্যস্ত করা হয়েছে, তারা এটাকে চাকরি হিসেবে নেয় না। দুদিন পরপর তাদের বদলি হয়, প্রকল্পও মুখ থুবড়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ধরন আলাদা হওয়া উচিত।

মুক্তিযুদ্ধ প্রকল্প বাস্তবায়নে তেমন অগ্রগতি না হওয়া এবং নির্ধারিত সময়ে নিজেদের বরাদ্দ খরচ করতে না পারায় ৬ মার্চ জাতীয় সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সরকারি দলেরই সাংসদ আবুল কালাম আজাদ। দক্ষতার অভাব এবং সঠিকভাবে পরিকল্পনা না থাকার কারণে প্রকল্প শেষ হয় না বলে মনে করেন এই সাংসদ। তিনি বলেন, অর্থবছরের আট মাস চলে গেছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৯৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। তারা এখন পর্যন্ত খরচ করেছে ১৭ কোটি টাকা।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তৃণমূল পর্যায়ে ও পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে না ধরা হবে, সঠিক ও নির্ভুল মুক্তিযুদ্ধ তালিকা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এ মন্ত্রণালয়কে লোকে একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানই বলবে। এ অবস্থা উত্তরণে শুধু কথার মধ্যে না থেকে প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।