বালুদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি গণকবরও

করতোয়া নদী থেকে বালু লুট করা হচ্ছে। গত শনিবার বগুড়া সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নে ডাকুরচক এলাকায়।  প্রথম আলো
করতোয়া নদী থেকে বালু লুট করা হচ্ছে। গত শনিবার বগুড়া সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নে ডাকুরচক এলাকায়। প্রথম আলো

বগুড়া সদর উপজেলার শহরতলির ডাকুরচক এলাকায় অবৈধ বালু তোলার কারণে প্রায় ৭০০ বিঘা কৃষিজমি করতোয়া নদীতে বিলীন হয়ে গেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। রেহাই পায়নি গণকবরও।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার রুহুল আমীন বলেন, ডাকুরচকের গণকবরের তালিকা প্রশাসনের কাছে দেওয়া আছে। তবে এখনো তালিকাভুক্ত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেখানে অনেক লোককে হত্যা করে কবর দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের তালিকাও রয়েছে।
জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি ২০০১ অনুযায়ী, কৃষিজমি যতটুকু সম্ভব কৃষিকাজে ব্যবহার করতে হবে এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না।
সদরের ফুলবাড়ী এলাকার পাশ দিয়ে করতোয়া নদী বয়ে গেছে। শহরের বগুড়া-মাটিডালি সড়ক থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে ফুলবাড়ী খেয়াঘাট। তবে এখন খেয়াঘাটের কোনো কার্যক্রম নেই। ঘাটে গেলে মনে হবে, নদীর খননকাজ চলছে। ছোট অর্ধশতাধিক নৌকায় করে বালু এনে খেয়াঘাট এলাকায় রাখা হয়েছে। তবে শুকনো মৌসুমে নৌকার চেয়ে ট্রাকে করেই বালু পরিবহন করা হয়। গত শনিবার খেয়াঘাটে বালুবোঝাই ২০টি ট্রাক দেখা গেছে। খেয়াঘাট থেকে প্রায় ২০ মিটার দক্ষিণ দিকে ডাকুরচক। সেখানে বালু তোলা হচ্ছে। এ কারণে শত শত বিঘা জমি করতোয়া নদীতে মিশে গেছে। এখানে অন্তত ৪০টি ইঞ্জিনচালিত যন্ত্র বসিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। ইঞ্জিনগুলো পানির ওপর রাখার জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে চৌকি বানানো হয়েছে। বালু তোলার এলাকা এখন শহরতলির রাজাপুর ও ফুলবাড়ী মৌজার মধ্যে পড়েছে।
ডাকুরচক এলাকায় পশ্চিম পাশে বালু তুলছেন মো. এনামুল হক ও হাসান আলী। জানতে চাইলে এনামুল বলেন, তাঁর ১০ বিঘা জমি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বালু তোলার কারণে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ১ হাজার ২০০টি আম ও ৭০০টি লিচুগাছের বাগান ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন বালু তুলে ৫০ শতকের আরেকটি মেহগনিগাছের বাগান রক্ষার চেষ্টা করছেন।
হাসান আলী বলেন, বালু ব্যবসায়ীদের কবলে পড়ে তাঁদের সাত বিঘা জমি নষ্ট হয়ে গেছে। এ ঘটনায় যুবদল নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। সেই মামলার আসামি তিনি ও তাঁর ভাই। তবে জমি রক্ষা হয়নি। তাঁরা জমি হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার পথে। তিনিও এখন বালু তুলছেন টিকে থাকার জন্য।
এলাকার বাসিন্দাদের দাবি, ১৯৭১ সালের এপ্রিলে ফুলবাড়ী এলাকার হাসান আলীর বাবা ছবেদ আলী, চাচা আবদুল জব্বারসহ অন্তত ৩০ জনকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে যায়। খেয়াঘাটের দিকে নিয়ে সবাইকে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করানো হয়। এরপর গুলি করে তাঁদের হত্যা করা হয়। পরে স্থানীয় বাসিন্দারা সেখান থেকে লাশগুলো কিছু দূরে নিয়ে ডাকুরচকে গর্ত করে কবর দেন। শহীদদের স্মরণে এখানে একটি সড়কের নামকরণ হয়েছে ‘ফুলবাড়ী গণশহীদ স্মৃতি সড়ক’।
হাসান আলী বলেন, ‘এখন যে এলাকা থেকে বালু তোলা হচ্ছে, সেখানে গণকবর ছিল। কিন্তু বালু তোলার কারণে তার চিহ্ন নেই। ১০ বছরের ব্যবধানে প্রায় ৭০০ বিঘা কৃষিজমি চোখের সামনে নদীতে পরিণত হতে দেখলাম।’
জানা গেছে, ডাকুরচক এলাকায় বালু তোলার সঙ্গে জড়িত আছেন বগুড়া পৌরসভার ১৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম। তিনি ডাকুরচকের পূর্ব প্রান্তে বালু তোলেন। তবে মুঠোফোনে তিনি বলেন, দুই বছর আগে তিনি বালু ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন।
বগুড়া পৌরসভার সাবেক কমিশনার ও ১৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার পূর্ব–দক্ষিণ প্রান্তে বালু তোলেন বলে একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করেছেন। তবে আনোয়ার বলেন, এখন তিনি এ এলাকায় আর বালু তোলেন না। অন্য এলাকায় তাঁর বালুর ব্যবসা আছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নুরু কয়েকটি ইঞ্জিন বসিয়ে বালু তুলছেন পূর্ব প্রান্তে। বালু তোলার সঙ্গে আরও অনেকে জড়িত আছেন।
বালু ব্যবসার কারণে কৃষিজমি হারিয়ে ফুলবাড়ী এলাকায় একটি ছোট্ট মুদির দোকান করছেন মো. বেতার মোল্লা। তাঁর স্বজনদের শতাধিক বিঘা জমি এখন বালু তোলার কারণে পানির নিচে। কয়েক বছর আগে সেখানে বেতার মোল্লার একটি গভীর নলকূপ ছিল। তবে শনিবার তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তখন স্থানীয় লোকজন বলেন, আওয়ামী লীগের লোকজন বালু তোলার সঙ্গে জড়িত। তাঁরা প্রতিদিন সকালে মোটরসাইকেল নিয়ে পুরা এলাকায় মহড়া দেন। খোঁজ নেন কেউ অন্য এলাকা থেকে বালু কিনছেন কি না। এখান থেকে উপজেলা নির্বাহী কার্যালয় (ইউএনও) দু-তিন কিলোমিটার দূরে।
জানতে চাইলে ইউএনও মো. আজিজুর রহমান বলেন, ডাকুরচকে বালু তোলার কারণে একাধিকবার ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করা হয়। বালু তোলার কারণে জায়গাটা এত বড় হয়েছে যে একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত দিয়ে কিছু হবে না। একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত দরকার। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা হয়েছে।
গণকবরের বিষয়ে ইউএনও বলেন, বগুড়া সদরে তালিকাভুক্ত মোট চারটি গণকবর রয়েছে। এগুলোতে বিশেষ দিনে রাষ্ট্রীয়ভাবে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এর বাইরে গণকবর আছে কি না, তা তাঁর জানা নেই।