নদীভাঙনে দিশেহারা মানুষ

যমুনার গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি। ১১ মার্চ মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার উত্তর বাচামারা গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
যমুনার গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি। ১১ মার্চ মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার উত্তর বাচামারা গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

বসতভিটাসহ ৪২ বিঘা জমির মালিক ছিলেন ওমর আলী। সংসারে ছিল সচ্ছলতা। এখন সব হারিয়ে তিনি নিঃস্ব। যমুনা নদীর ভাঙনে থাকার মতো জায়গাটুকু নেই তাঁর। পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকছেন অন্যের জমি ভাড়া করে।
মানিকগঞ্জের দৌলতপুরের বাচামারা ইউনিয়নের মুসলিমনগর গ্রামে বসতবাড়িসহ ফসলি জমি ছিল ওমর আলী মোল্লার (৬৫)। জমিজমা ও বসতভিটা নদীতে হারিয়ে তিনি বাচামারা কাচারিপাড়া গ্রামে আবদুল হাকিম নামের এক ব্যক্তির ১৩ শতক জমি ভাড়া নিয়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন।
১১ মার্চ বাচামারা বাজারে কথা হলে ওমর আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৯৮৮ সালের বন্যার পর থেকে চার-পাঁচ বছরে আমার ৪২ বিঘা আবাদি জমি নদীগর্ভে চলে গেছে। শেষ সম্বল বসতভিটাও নদীতে ভেঙে যায়।’
শুধু ওমর আলী নন, তাঁর মতো অসংখ্য পরিবার যমুনার ভাঙনে বাস্তুহারা। এমনই আরেকজন ভুক্তভোগী আবু হানিফ (৬০)। তিনি জানান, বাচামারা ইউনিয়নের হাজিপাড়া গ্রামে বাড়ি ছিল তাঁর। ছিল গোলাভরা ধান। ভাঙনের কবলে বসতবাড়ি ও ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। পরিবার নিয়ে তাঁরও ঠাঁই হয়েছে অন্যের জায়গায়।
মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে যমুনা। উপজেলার বাচামারা, চরকাটারী, বাঘুটিয়া ও জিয়নপুর ইউনিয়ন ভাঙনকবলিত এলাকা। এসব ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম নদীগর্ভে চলে গেছে। প্রতিবছরই ভাঙনের কারণে এসব ইউনিয়নের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি ক্লিনিক, মসজিদ-মাদ্রাসা, হাটবাজারসহ হাজার হাজার বিঘা জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। অনেকের বসতভিটা ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে। এখনো যাঁদের ঘরবাড়ি নদীর তীরে আছে, তাঁরা আছেন মহা–আতঙ্কে। কারণ, যেকোনো সময় তাঁদের ঘর, গাছপালা ও জমি নদীগর্ভে চলে যেতে পারে। এ পরিবারগুলো উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
১১ মার্চ বাচামারা উত্তরখন্ড গ্রামে দেখা যায়, নদী ভাঙছে। স্থানীয়রা জানান, অনেক পরিবারের বসতভিটা আগেই নদীগর্ভে চলে গেছে। কোনো কোনো পরিবারের লোকজন ঘরবাড়ি ও মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ায় বসতভিটার অবশিষ্ট চিহ্নটুকু রয়ে গেছে।
চরকাটারী ইউনিয়নের বোর্ডঘর বাজার এলাকার আশপাশে দেখা যায়, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বেশ কয়েকটি অস্থায়ী ছোট টিনের ঘর। দেখলে বোঝা যায়, অন্য স্থান থেকে সরিয়ে নিয়ে এসে বসানো হয়েছে। সেখানেই গাদাগাদি করে বসবাস করছে এসব পরিবার।
নদীভাঙনে চরকাটারী ইউনিয়নে শিক্ষাক্ষেত্রেও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গত তিন বছরে ইউনিয়নের করিম মোল্লা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, করিম মোল্লার পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিকদারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং চর গোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ চরকাটারী সবুজ সেনা উচ্চবিদ্যালয় নদীগর্ভে চলে গেছে। অবকাঠামো না থাকায় বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে।
বাচামারা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ বলেন, এই ইউনিয়নে রয়েছে বাচামারা বড় বাজার, ইউনিয়ন পরিষদ, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র, ভূমি অফিস, একটি কলেজ, দুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও খেলার মাঠসহ ফসলি জমি। প্রতিবছর নদীভাঙনে ইউনিয়নটি ছোট হয়ে আসছে। নদীর পূর্ব-উত্তর অংশে মাত্র তিন থেকে চার কিলোমিটার স্থায়ী বাঁধ দেওয়া হলে এসব স্থাপনা ও জমি রক্ষা করা সম্ভব।
স্থানীয় সাংসদ নাঈমুর রহমান দুর্জয় প্রথম আলোকে বলেন, যমুনা বিশাল নদী। এর ভাঙনের ভয়াবহতাও বিশাল। কাজেই এই নদীভাঙন ফেরাতে বড় আকারে খননকাজ (ড্রেজিং) এবং বাঁধ নির্মাণের বিকল্প নেই। এই ড্রেজিং এবং নদীভাঙন রোধে বাঁধ নির্মাণে বড় প্রকল্পের প্রয়োজন। এ বিষয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে তিনি চাহিদাপত্রও (ডিও লেটার) দিয়েছেন।
যোগাযোগ করা হলে পাউবোর মানিকগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবে মওলা মো. মেহেদী হাসান বলেন, বাচামারা ও চরকাটারী ইউনিয়নে নদীর তীর রক্ষায় একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাউবোর বিশেষজ্ঞ দল সেখানে পরিদর্শনও করেছে। প্রকল্প অনুমোদনের পর অর্থ বরাদ্দ পাওয়া গেলে বাঁধের কাজ শুরু হবে। তিনি আরও বলেন, এবার বর্ষায় অস্থায়ী ভাঙন প্রতিরোধে ওই দুটি ইউনিয়নে জরুরি ভিত্তিতে ১০ হাজার জিও ব্যাগ বরাদ্দ রাখা হয়েছে।