নারীকে ইয়াবায় ফাঁসানোর মামলায় ওসিকে বাদ দিয়ে পরোয়ানা

সাত মাস আগে এক নারীকে ধর্ষণের পর রাস্তায় ফেলে রাখেন তাঁর স্বজনেরা। পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে সীতাকুণ্ড থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) দুই পুলিশ সদস্য ওই নারীর কাছ থেকে দুই হাজার ইয়াবা বড়ি উদ্ধার দেখিয়ে মামলা করেন। আদালতের নির্দেশে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এবং নগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের তদন্তে বিষয়টি উঠে এসেছে।

ডিবির প্রতিবেদনটি গ্রহণ করে দুই পুলিশসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। বুধবার লিখিত আদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৬–এর বিচারক মঈন উদ্দীন এই আদেশ দেন। ওসির বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নেওয়ার জন্য আগামী ধার্য দিনে আদালতে আবেদন করবেন ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি। ঘটনার সময় ওসি ইফতেখার হাসান সীতাকুণ্ড থানায় কর্মরত ছিলেন। এখন তিনি জোরারগঞ্জে রয়েছেন।

ওই নারী বলেন, সেদিন থানায় ওসিকে প্রকৃত ঘটনা বলা হলেও তিনি শোনেননি। ওই নারীর স্বামী প্রথম আলোকে বলেন, ‘খবর পেয়ে সীতাকুণ্ড থানায় গেলেও ওসি তাঁর কক্ষে ঢুকতে দেননি। ওসির সম্মতি ছাড়া ইয়াবা দিয়ে মামলা দেওয়া যায় কি? তাঁকে কেন বাদ দেওয়া হলো বুঝতেছি না।’

অপরাধ আমলে নেওয়া আসামিরা হলেন উপপরিদর্শক (এসআই) সিরাজ মিয়া, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) জাকির হোসাইন, ওই নারীর স্বামীর মৃত প্রথম স্ত্রীর ছেলে, তাঁর স্ত্রী, বড় মেয়ে, তাঁর স্বামী, ছেলের শ্যালক, তাঁদের চার সহযোগী ও ওই নারীর প্রথম স্বামী। এর মধ্যে ওই নারীর স্বামীর মৃত প্রথম স্ত্রীর ছেলের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, অপহরণ ও মাদক সরবরাহের অপরাধ, বাকিদের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানি, অপহরণ ও মাদক সরবরাহের অপরাধ আমলে নেন আদালত। এসআই সিরাজ মিয়া সীতাকুণ্ড থেকে বদলি হয়ে বর্তমানে রাঙামাটি জেলা ডিবি পুলিশে কর্মরত। এএসআই জাকির হোসাইন রয়েছেন সীতাকুণ্ড থানায়। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত থানায় জাকির হোসাইনের নামে কোনো পরোয়ানা যায়নি বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৬–এর সরকারি কৌঁসুলি নজরুল ইসলাম তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার রাতে ওসির সঙ্গে মুঠোফোনে দুই পুলিশ সদস্যসহ বাকিরা কে কতবার কথা বলেছেন সব তদন্ত প্রতিবেদনে রয়েছে। এমনকি এক পুলিশ সদস্য ওসিকে খুদে বার্তাও পাঠান। ওসির মতামত ছাড়া এই মামলা রেকর্ড হতে পারে না। নির্যাতনের শিকার এক নারীকে চিকিৎসা না করিয়ে উল্টো ইয়াবা মামলায় ফাঁসানোর ঘটনার দায় থানার ওসি এড়াতে পারেন না।

এই সরকারি কৌঁসুলি আরও বলেন, আগামী ধার্য দিনে ওসির বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নেওয়ার জন্য আদালতে আবেদন করা হবে।

২০১৮ সালের ২৯ আগস্ট নগরের হালিশহরে বাসায় ঢুকে এক নারীকে ধর্ষণ করা হয়। পরে তাঁকে সীতাকুণ্ড নিয়ে নির্জন একটি স্থানে ফেলে রাখা হয়। সেখান থেকে পুলিশ ওই নারীকে দুই হাজার ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়। পুলিশের করা মাদক মামলায় কারাগারে যান তিনি। এরপর স্ত্রীকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগে আদালতে মামলা করেন স্বামী। আদালত ডিবি পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দেন। অন্যদিকে স্ত্রী জামিনের আবেদন করলে চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালত বিষয়টি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন।

তদন্ত শেষে দুটি সংস্থা এ বছরের শুরুতে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে কীভাবে, কেন ওই নারীকে ধর্ষণের পর ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানো হয়েছে, তার বর্ণনা রয়েছে। জড়িত আসামিদের কার কী ভূমিকা ছিল, তা-ও তুলে ধরা হয়েছে।

ডিবির প্রতিবেদনে রয়েছে, সীতাকুণ্ড থানার ওসি ইফতেখার হাসানের সহায়তায় এসআই সিরাজ মিয়া ও এএসআই জাকির হোসাইনের মাধ্যমে একটি সাজানো মাদক মামলায় এক নারীকে ফাঁসানো হয়েছে বলে তদন্তে পাওয়া গেছে। পিবিআইর প্রতিবেদনে সীতাকুণ্ড থানা-পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে মিথ্যা মাদক মামলায় ফাঁসানোর বিষয়টি প্রমাণিত হয়।

সোমবার সন্ধ্যায় সীতাকুণ্ড থানার সাবেক ওসি ইফতেখার হাসান প্রথম আলোকে বলেন, থানার এসআই মামলা দেওয়ায় তিনি নিয়েছেন। ঘটনা যদি মিথ্যা হয়ে থাকে তবে পরে তদন্ত করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া যেত।

তবে দুই পুলিশ সদস্য দাবি করেন, ওসির পরামর্শে সব হয়েছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে অপরাধ করে পার পেয়ে গেলে ভবিষ্যতে এ রকম ঘটনা বাড়তে থাকবে।