সড়কে নিহত মানুষের সাড়ে ১২% শিক্ষার্থী

>

* ১৯৯৮–২০১৪ সাল পর্যন্ত সড়কে হতাহত ৪৬ হাজার ৮৬ জন
*হতাহতদের মধ্যে ৬–২৫ বছর বয়সীর সংখ্যা ১৫ হাজার ৫৬৬
*তরুণেরাই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার বেশি হচ্ছে
*তরুণদের মধ্যে বড় অংশ শিক্ষার্থী ও কর্মক্ষম

সড়কে শিক্ষার্থীদের জীবন বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। গত পাঁচ বছরে সড়কে প্রাণ ঝরেছে ৪ হাজার ৭৪১ শিক্ষার্থীর। এ সময় যত মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন, এর ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী। নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের পরও এই মৃত্যুর মিছিল থামছে না।

এই তথ্য বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির। অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সমীক্ষা বলছে, ১৯৯৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সড়কে যাত্রী ও পথচারী হতাহত হয়েছেন ৪৬ হাজার ৮৬ জন। এর মধ্যে ৬ থেকে ২৫ বছর বয়সীর সংখ্যা ১৫ হাজার ৫৬৬। অর্থাৎ ৩৩ দশমিক ৭৭ শতাংশই তরুণ। আবার গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত জানুয়ারি থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত সড়কে অন্তত ২৫ জন শিক্ষার্থীর প্রাণ ঝরেছে। এর মধ্যে পাবনা ও খুলনায় দুজন মেডিকেলের শিক্ষার্থী রয়েছেন।

গত মাসে খুলনায় একসঙ্গে গোপালগঞ্জের চার শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। গত মঙ্গলবারই সকালে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে কুমিল্লায় প্রাণ হারিয়েছেন দুই ছাত্রী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে সড়কে তরুণ শিক্ষার্থী এবং কর্মক্ষম মানুষের প্রাণহানি দেশের আর্থসামাজিক উন্নতির অন্তরায়। কর্মক্ষম একজন মানুষ নিহত হওয়া কয়েকজনের প্রাণহানির সমান। কারণ, পরিবারের উপার্জনকারীর মৃত্যুতে তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের জীবনও এলোমেলো হয়ে যায়। আর শিক্ষার্থীরা জাতির মেরুদণ্ড—এটা তো সর্বজনস্বীকৃত।

গত বছরের ২৯ জুলাই রাজধানী ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনের বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর সারা দেশে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে। ওই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরী। ১৯ মার্চ তিনিও প্রগতি সরণিতে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারান। তাঁর মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আবারও রাস্তায় নামে শিক্ষার্থীরা।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে শিক্ষার্থীদের মৃত্যু দেশের জন্য বিপর্যয়কর। এটা থেকে উত্তরণের জন্য বেপরোয়া চালককে অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে মাসে অন্তত একবার শিক্ষার্থীদের নিয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করতে হবে।

হাতে হাতে ব্যানার-ফেস্টুন। মুখে মুখে স্লোগান। দাবি নিরাপদ সড়ক আর বাস থেকে ফেলে শিক্ষার্থী ঘোরি মো. ওয়াসিম ‘হত্যা’র দ্রুত বিচার। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। এই বিক্ষোভ মিছিলের পর শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করেন।  ছবি: আনিস মাহমুদ
হাতে হাতে ব্যানার-ফেস্টুন। মুখে মুখে স্লোগান। দাবি নিরাপদ সড়ক আর বাস থেকে ফেলে শিক্ষার্থী ঘোরি মো. ওয়াসিম ‘হত্যা’র দ্রুত বিচার। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। এই বিক্ষোভ মিছিলের পর শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করেন। ছবি: আনিস মাহমুদ

সরকারিভাবে সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য সংরক্ষণ করে পুলিশ। তাদের তথ্য ধরে ২০১৪ সালে করা ব্র্যাকের গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার ৩৮ দশমিক ১ শতাংশেরই উৎস বাস। আর ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ দুর্ঘটনায় যুক্ত ট্রাক। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, দেশে প্রায় ১৮ লাখ যানবাহন চলছে ভুয়া চালক দিয়ে। সারা দেশে প্রায় ৫ লাখ ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলছে। ৬২ শতাংশ জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে যথাযথ সাইন-সংকেত নেই।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মুখে গত বছরের সেপ্টেম্বরে সরকার তড়িঘড়ি করে সড়ক পরিবহন আইন পাস করে। আইনে দুর্ঘটনায় দায়ী চালকের শাস্তির ধারা কিছুটা কঠোর, ফিটনেসবিহীন যানবাহন পরিচালনার দায়ে জরিমানা বৃদ্ধি এবং প্রথমবারের মতো সড়কের ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনা হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে দায়ী করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু এখনো এই আইন কার্যকর হয়নি। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সর্বোচ্চ ফোরাম জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠকে আইন বাস্তবায়নে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। কমিটির সদস্যরা হলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম। কিন্তু কমিটি এরপর কোনো বৈঠকই করেনি।

১৭ ফেব্রুয়ারির বৈঠকে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খানকে প্রধান করে আরেকটি কমিটি করা হয়। কমিটির সদস্যরা পাঁচটি বৈঠক করেছেন। একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, কমিটির সদস্যদের বেশির ভাগই মালিক ও শ্রমিক সমিতির নেতা। তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া কীভাবে চালকদের লাইসেন্স পাওয়া যাবে, এটা নিশ্চিত করা। কয়েকটি বৈঠকে এটিও শ্রমিকনেতারা তুলেছেন। এর আগেও শ্রমিক ফেডারেশনের চাহিদা মেনে প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার পেশাদার চালকের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। তবে কমিটিতে থাকা বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা সুনির্দিষ্ট সুপারিশ তৈরির ওপর জোর দেন। আশু করণীয়, স্বল্পমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি ও চলমান প্রক্রিয়া—এই চার ভাগে ভাগ করে প্রাথমিকভাবে ১১১টি সুপারিশও তৈরি করা হয়েছে। তবে তা এখনো প্রকাশ করা হয়নি।

৫ বছরে শিক্ষার্থীর প্রাণহানি
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিকে প্রকাশিত এবং টেলিভিশনে প্রচারিত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনার ওপর প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাদের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় সারা দেশে ৭ হাজার ২২১ জন মারা যান। এর মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮৮০। অর্থাৎ মোট নিহতের ১২ দশমিক ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। ২০১৭ সালে দুর্ঘটনায় মোট নিহতদের মধ্যে শিক্ষার্থীর হার ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ, ২০১৬ সালে ১৩ দশমিক ২৬ শতাংশ, ২০১৫ সালে ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে এই হার ছিল ১৪ দশমিক ৬২ শতাংশ।

১৭ বছরের সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ দেখা যায়, দেশে সবচেয়ে বেশি ৪৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয় মহাসড়কে। শহরাঞ্চলে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ২৩ শতাংশ, আঞ্চলিক মহাসড়কে ১৩ শতাংশ এবং বাকি ২১ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্ম গ্রামীণ সড়কে। আর দুর্ঘটনার ১৯ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষের কারণে হয়। এসব সংঘর্ষের ৭০ শতাংশই প্রাণঘাতী।

ব্র্যাকের করা ২০১৫ সালের এক গবেষণায় এসেছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সবচেয়ে বেশি ৪১ শতাংশই পথচারী। এরপর ১৯ শতাংশ প্রাণ যায় বাস বা অন্য যানের যাত্রীদের। মোটরসাইকেল বা থ্রীহুইলার আরোহী আছেন ১৬ শতাংশ।

চালকেরা বেপরোয়া
মামলা হলে দুর্ঘটনার বিষয়ে পুলিশের দেওয়া প্রতিবেদনে ৬০ টির মতো তথ্য উল্লেখ থাকে। এর মধ্যে দুর্ঘটনায় দায়ী কে, তা-ও চিহ্নিত করা হয়। ১৯৯৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত হওয়া দুর্ঘটনা প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা ইনস্টিটিউট (এআরআই) বলছে, ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনার পেছনে অতিরিক্ত গতি ও চালকের বেপরোয়া মনোভাব দায়ী।

জানতে চাইলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ, সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার বড় উৎস বাস-ট্রাক। এই যানগুলোতে আয় বাড়াতে সময় মেনে চলতে চায়। শিক্ষার্থী ও অফিসগামীরাও সময় মেনে চলেন। তবে বাণিজ্যিক যানের চালকের লাইসেন্স, ফিটনেস, চলাচলের অনুমতি কোনোটাই ঠিক নেই। একটা অনিয়মের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। ফলে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছেন শিক্ষার্থী ও অফিসগামীরা। পরিবহন খাতে আইনের কঠোর প্রয়োগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এলাকা নির্দিষ্ট করে দিয়ে এবং শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ বাস চালু করে কিছুটা পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। নতুবা দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা যত উন্নতি হবে, ঝুঁকি তত বাড়বে।