সাত খাল দখল করে সেতুসহ নানা স্থাপনা

খাল দখল করে এক পাশে তৈরি করা হয়েছে স্থাপনা, ওপারে সেতু। চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার বরদিয়া আড়ং বাজার এলাকায় রাঢ়ীরখালে। ছবি: প্রথম আলো
খাল দখল করে এক পাশে তৈরি করা হয়েছে স্থাপনা, ওপারে সেতু। চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার বরদিয়া আড়ং বাজার এলাকায় রাঢ়ীরখালে। ছবি: প্রথম আলো

চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলায় সাতটি খাল দখল করে দোকানপাট, ঘরবাড়ি ও পাকা সেতু নির্মাণ করেছেন স্থানীয় লোকজন। এতে এসব খালের অস্তিত্ব ও জলজ জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পানির প্রবাহ। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য।
ওই সাতটি খাল হলো চরপাথালিয়া, নলুয়া, দিঘলদী, দূরগাঁও, ধনারপাড়, বাইশপুর ও রাঢ়ীর খাল।
সম্প্রতি এসব খাল ঘুরে দেখা যায়, খালগুলোর বিভিন্ন অংশের ওপর স্থানীয় লোকজন বাঁশের সাঁকো ও ৪০-৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের পাকা সেতু নির্মাণ করেছেন। দুই পাড়ে ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও অন্যান্য স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি খাল গড়ে এক-দেড় শ লোক দখল করেছেন। শুধু রাঢ়ীর খালের ওপরই ৫০টির বেশি পাকা সেতু তৈরি করা হয়েছে।
রাঢ়ীর খালে চলাচলকারী কার্গোর চালক মো. সফিক বলেন, ‘খালডার এট্টু পরপর সেতু। এগুলোর পিলারে কচুরি আটকাইয়া থাহে। ঠিকমতো কার্গো চালান যায় না।’
মতলব সরকারি কলেজের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জি এম হাবিব খান বলেন, খাল বা নদী দখল হলে জলজ জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়। দখলের এ প্রতিযোগিতা বন্ধ হওয়া উচিত। পুনরুদ্ধার করে এসব খাল পুনঃখনন করাও দরকার। উপজেলা ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, মতলব দক্ষিণে সরকারি ১৮টি খাল রয়েছে। এগুলো হলো চরপাথালিয়া, নারায়ণপুর, নলুয়া, দিঘলদী, দূরগাঁও, কাশিমপুর-পূরণ, লক্ষ্মীপুর, সাড়পাড়, নাগদা, পুটিয়া, লামচরী, তেলী মাছুয়াখাল, শাহাপুর, টেমাই, ধনারপাড়, করবন্দ, বাইশপুর ও রাঢ়ীর খাল। এসব খাল প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো এবং সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত। এর মধ্যে ওই সাতটি খালের কিছু অংশ দখল হয়ে গেছে। দখলের প্রক্রিয়ায় রয়েছে আরও কিছু অংশ। স্থানীয় লোকজন ১৫-২০ বছর ধরে এসব খালের ওপর এবং পাড়ে ঘরবাড়ি, সেতু, দোকান ও অন্যান্য স্থায়ী-অস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। খালগুলোর কোনো কোনো অংশে এখনো অবৈধ নির্মাণ অব্যাহত আছে।

কার্যালয় সূত্রে আরও জানা যায়, মতলব পৌরসভার চরপাথালিয়া থেকে চরনীলক্ষ্মী পর্যন্ত বয়ে যাওয়া খালটি চরপাথালিয়া। এটির আয়তন প্রায় ২৬ একর ও গড় প্রস্থ ৪৫ ফুট। উত্তর ও দক্ষিণ নলুয়া এলাকার ওপর দিয়ে প্রবাহিত খালের নাম নলুয়া। এটির আয়তন প্রায় ১৫ একর, এটির গড় প্রস্থ ৫০ ফুট। উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ দিঘলদী এলাকার ওপর দিয়ে প্রবাহিত খালটি দিঘলদী। এটির আয়তন প্রায় ৪৭ একর ও গড় প্রস্থ ৬৫ ফুট। দূরগাঁও ও বোয়ালিয়া এলাকার ওপর দিয়ে প্রবাহিত খালের নাম দূরগাঁও। এটির আয়তন প্রায় ৩ একর, গড় প্রস্থ ২৫ ফুট। ভাঙ্গারপাড় থেকে ধনারপাড় এলাকা পর্যন্ত বয়ে যাওয়া খালটি ধনারপাড়। এটির আয়তন প্রায় ৮৬ একর ও গড় প্রস্থ ৬০ ফুট। বাইশপুর থেকে ধনারপাড় পর্যন্ত বয়ে যাওয়া খালের নাম বাইশপুর। এটির দৈর্ঘ্য ৫ কিলোমিটার ও গড় প্রস্থ ৬০ ফুট। চরমুকুন্দি থেকে বাবুরহাট এলাকাজুড়ে বহমান খালটি রাঢ়ীর খাল। এটির দৈর্ঘ্য ১৬ কিলোমিটার ও গড় প্রস্থ ৪০ ফুট। এসব খাল মতলব পৌরসভার বিভিন্ন মৌজার খাস খতিয়ানভুক্ত।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, রাঢ়ীর খালের মুন্সীরহাট, বরদিয়া ও বরদিয়া আড়ং বাজারের পশ্চিম পাশে চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এর পাড় ও মধ্যের ১৫-১৬ ফুট জায়গায় গড়ে উঠেছে অবৈধ দোকানপাট। এসব দোকানের বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে খালের পানি। অনেক স্থানে খাল দখল করে এপার-ওপার সেতু বানিয়েছেন শতাধিক লোক। খালটির ৪০-৫০ গজ দূরত্বে একটি করে সেতু বা সাঁকো রয়েছে। এগুলোর পিলার বা খুঁটিতে কচুরিপানার জট লেগে আছে। এতে খালে পানির প্রবাহ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশির নৌকা, স্পিডবোট, কার্গো ও ট্রলারের চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে।
মুন্সীরহাট এলাকার দোকানি নাসির হাজরা ও বরদিয়া আড়ং বাজারের দোকানি নজরুল ইসলাম বলেন, তাঁরা খালের পাড়ে দোকান করেন। তবে দোকানের কিছু অংশ খালের ভেতর ঢুকে গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মুন্সীরহাট এলাকার চারজন বাসিন্দা বলেন, প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া তাঁদের এলাকার অনেকেই খাল দখল করে দোকান ও সেতু করেছেন। এলাকার ১০-১২ জন করে মিলে একেকটি সেতু তৈরি করেছেন।
জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহিদুল ইসলাম বলেন, যেসব লোক খাল দখল করে অবৈধভাবে দোকান, ঘরবাড়ি, সেতু ও বিভিন্ন স্থাপনা বানিয়েছেন বা বানাচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। খালগুলো পুনরুদ্ধারে অভিযান চালানো হবে।