সন্তানের লৈঙ্গিক পরিচয় জেনে নিচ্ছেন ৪০ শতাংশ গর্ভবতী

>

* ভ্রূণের লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে গবেষণা
* ৬০% গর্ভবতী নারীর ছেলে বা মেয়ের ব্যাপারে পক্ষপাতিত্ব নেই
* দেশে ১০৫ ছেলেশিশুর বিপরীতে ১০০ মেয়েশিশু জন্ম নিচ্ছে
* সিলেট বিভাগে ১০৭ ছেলের বিপরীতে ১০০ মেয়েশিশুর জন্ম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভের সন্তানের লিঙ্গ শনাক্তকরণের প্রযুক্তি সম্পর্কে ৯৯ শতাংশ গর্ভবতী মায়ের ধারণা আছে। সন্তান ছেলে না মেয়ে হবে, তা জানতে ৪০ শতাংশ গর্ভবতী আলট্রাসনোগ্রাফি ব্যবহার করেন। গবেষকেরা বলছেন, ভ্রূণের লিঙ্গ শনাক্তকরণে দেশে আলট্রাসনোগ্রাফির ব্যবহার খুব বেশি হচ্ছে।

‘বাংলাদেশে জন্মের পূর্বে শিশুর লিঙ্গ নির্বাচনের ক্ষেত্রে লৈঙ্গিক পক্ষপাতিত্ব: কারণ ও ফলাফল অনুসন্ধান’ শীর্ষক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণাটি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এই গবেষণা ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে গবেষকেরা বলেছেন, দেশে বাছাই করে কন্যা ভ্রূণ হত্যার ঘটনা তাদের গবেষণায় ধরা পড়েনি।

গবেষণায় দেখা গেছে, ছেলেসন্তানের ব্যাপারে দুর্বলতা ২৮ শতাংশ বিবাহিত নারীর। মেয়েসন্তানের ক্ষেত্রে তা ১২ শতাংশ। বাকি ৬০ শতাংশ নারীর কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই। গবেষকেরা বলছেন, অধিকাংশ নারীর মধ্যে এই পক্ষপাতহীন মনোভাব গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম বড় ভূমিকা রেখেছে।

পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের শিক্ষক ও গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক এ কে এম নূরুন নবী গবেষণার প্রেক্ষাপট ও ফলাফল উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, চীনে ১১৫টি ছেলেশিশুর বিপরীতে ১০০ মেয়েশিশু জন্ম নেয়। ভারত, পাকিস্তান, আজারবাইজান, জর্জিয়ায় ছেলেশিশু বেশি জন্ম নিচ্ছে। এসব দেশে জন্মের সময় লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য আছে। গর্ভকালে লিঙ্গ শনাক্তকরণ প্রযুক্তির ব্যবহার আছে, ছেলেসন্তানের প্রতি দুর্বলতা বেশি এবং প্রজনন হার কম—এমন দেশগুলোতে এই তিনটি শর্ত জন্মের সময় লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশে এই তিনটি শর্তই পূরণ হয়েছে।

গবেষণায় ঢাকা, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, গাজীপুর, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জের ১৫-৪৯ বছর বয়সী ২ হাজার ৬১০ জন বিবাহিত নারীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। এসব নারীর পাঁচ বছর বা তার কম বয়সী কমপক্ষে একটি সন্তান আছে। এ ছাড়া ৩৪টি সেবা কেন্দ্র, ২১ জন নারী ও ২১ জন স্বামীর বিশেষ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।

গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, ৮৮ শতাংশ গর্ভবতী মা বলেছেন, তাঁদের এলাকাতেই গর্ভের সন্তানের লিঙ্গ শনাক্তকরণ প্রযুক্তির সুবিধা আছে। ৮৯ শতাংশ নারী বলেছেন, এনজিও চালিত হাসপাতাল বা ক্লিনিকে এই সুযোগ বেশি পাওয়া যায়। গবেষকেরা আলট্রাসনোগ্রাফির ব্যবহারের ওপর নজরদারি বাড়ানোর সুপারিশ করেছেন।

অধ্যাপক এ কে এম নূরুন নবী বলেন, বাংলাদেশে ১০৫ জন ছেলেশিশুর বিপরীতে ১০০ মেয়েশিশু জন্ম নেয়। সিলেট বিভাগে ১০৭ ছেলেশিশুর বিপরীতে ১০০ মেয়েশিশু জন্ম নিচ্ছে। সিলেটে কন্যা ভ্রূণ হত্যার হচ্ছে কি না, সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, সিলেটের পরিস্থিতি আরও অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমন্বয় ও সহযোগিতা কর্মকর্তা এভেঞ্জেলিনা ব্লাঙ্কো গঞ্জালেজ বলেন, গর্ভকালে ভ্রূণের পরিচয় জানার চর্চা থাকলে কন্যাশিশু কমে যাওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। কন্যাশিশু কমলে জোর করে বিয়ে করার, নারী পাচার, নারীর প্রতি সহিংসতার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

গবেষণাটিকে অত্যন্ত মূল্যবান বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম। তিনি বলেন, আলট্রাসনোগ্রাফির ব্যবহার বেশি হচ্ছে, মাসিক নিয়মিতকরণের (এমআর) আড়ালে গর্ভপাত হচ্ছে, কিন্তু কন্যা ভ্রূণ হত্যা হচ্ছে কি না জানা যাচ্ছে না। এ নিয়ে আরও অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণের প্রয়োজন।

ইউএনএফপিএর প্রতিনিধি ইকো নারিতা বলেন, এ গবেষণা বাংলাদেশে নারী-পুরুষ বৈষম্যের বিশেষ ইঙ্গিত দেয়। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা তৈরিতে এই ফলাফল বিশেষ কাজে লাগবে।

পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ মাইনুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের আরও বক্তব্য দেন নারী ও শিশুবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মেহের আফরোজ, গবেষণা দলের সদস্য সাফায়েত সুলতান।