'ভাই, মারা যাচ্ছি, আমার ছেলেমেয়েকে দেখে রাখিস'

মঞ্জুর হাসান। ছবি: সংগৃহীত
মঞ্জুর হাসান। ছবি: সংগৃহীত

সড়ক দুর্ঘটনায় চলনশক্তি হারানো মঞ্জুর হাসান (৫০) চাকরি করতেন এফ আর টাওয়ারের ২১তম তলায়। জীবনের শেষে মুহূর্তে তিনি মোবাইল ফোনে ছেলেমেয়েদের ছোট ভাইয়ের কাছে সঁপে যান। নওগাঁ সদর উপজেলার বোয়ালিয়া পূর্বপাড়া গ্রামের এই বাসিন্দা পরিবার নিয়ে ঢাকার ইব্রাহিমপুরে নিজ বাসায় থাকতেন।

মৃত্যুর আগে মঞ্জুরের শেষ কথাগুলো প্রথম আলোর কাছে বর্ণনা করেছেন তাঁর ছোট ভাই মোনাক হাসান শিমুল। শিমুলের ভাষ্যমতে মঞ্জুর শেষ কথাগুলো মোবাইলে ফোনে তাঁর আরেক ভাই মেহফুজ জুবায়ের পলাশের সঙ্গে বলেছিলেন এভাবে, ‘ভাই, আমি মারা যাচ্ছি। সবাই অফিস থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে কেউ আমাকে সাহায্য করছে না। উপায় না পেয়ে আমি অফিসের চেয়ারেই বসে আছি। তোরা আমার জন্য দোয়া করিস। ছেলেমেয়েকে দেখে রাখিস।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি করেছেন মঞ্জুর। সর্বশেষ কাশেম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে কর্মরত ছিলেন।

মঞ্জুরের ছোট ভাই মোনাক হাসান শিমুল বলেন, ‘ভাই চাকরিরত অবস্থায় ২০০০ সালে কাশেম গ্রুপের মতিঝিল অফিসের সামনের রাস্তায় সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন। দুর্ঘটনার পর থেকে তিনি ক্রাচ ও হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতেন। এক প্রকার পঙ্গু জীবন যাপন করতেন। কিন্তু তারপরও কোম্পানি ভাইকে চাকরি থেকে বাদ দেয়নি। পরবর্তী সময় তাঁকে বনানীর হেড অফিসে চাকরিতে রেখে দিয়েছিল।’

মোনাক হাসান আরও বলেন, ‘বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে এফ আর টাওয়ারে যখন আগুন লাগে, তখন মঞ্জুর হাসান ওই ভবনের ২১তম তলায় কাশেম গ্রুপের অফিসে অবস্থান করছিলেন। যখন আগুন লাগে সবাই বাঁচার জন্য ছোটাছুটি করছিল। কিন্তু ভাই পঙ্গু হওয়ায় কিছু করার উপায় ছিল না। সবাই নিজের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত ছিল। তাঁকে কেউই সাহায্য করেনি। তিনি অফিসে বসেই মোবাইল ফোনে আমাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন আর দোয়া চেয়েছিলেন। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে তাঁর শেষ কথা হয় আমার আরেক ভাই মেহফুজ যুবায়েরের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।’

ব্যক্তিজীবনে মঞ্জুরের স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। স্বজনদের ভাষ্যমতে, তিনিই ছিলেন তাঁর পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে মঞ্জুর ছিলেন তৃতীয়।

আজ শুক্রবার দুপুরে মঞ্জুরের গ্রামের বাড়ি বোয়ালিয়াতে গিয়ে দেখা যায়, মঞ্জুর হাসানের মৃত্যুতে পুরো গ্রামে যেন শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তাঁর মৃত্যুর বিষয় নিয়েই সবাই হা-হুতাশ করছিলেন। মঞ্জুর হাসানের এক ভাই ছাড়া তাঁর প্রায় সব নিকটাত্মীয় ঢাকায় থাকেন। ছোট ভাই মোনাক হাসান ওরফে শিমুল একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার বগুড়া অফিসে চাকরি করেন। শুধু তিনিই গ্রামের বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকেন। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের সময় তিনি গ্রামের বাড়িতেই ছিলেন। ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলেই তিনি ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন।

মঞ্জুরের স্বজনেরা জানিয়েছেন, মঞ্জুরকে ঢাকার ইব্রাহিমপুরে দাফন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় উদ্ধারকর্মীরা মঞ্জুরের মরদেহ উদ্ধার করে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে সেখানে তাঁর মরদেহ শনাক্ত করা হয়।

মঞ্জুরের চাচাতো ভাই সাবেক সেনাসদস্য ফজলুর রহমান বলেন, ‘যখন ঢাকায় থাকতাম নিয়মিত তার (মঞ্জুরের) সঙ্গে দেখা করতাম। তার অফিসে যেতাম। তাকে ধরে ওঠা-বসা করাতে হতো। তাঁর সহকর্মীরাও তাকে অনেক সাহায্য করত। কিন্তু গতকালের দুর্যোগের সময় সবাই প্রাণভয়ে ছিল। সবাই অফিস থেকে বের হতে পারলেও মঞ্জুর বের হতে পারেনি। যখন আগুন লাগার সংবাদ পেলাম তখন ধারণা করেছি, হয়তো সে আর বের হতে পারবে না।’ তিনি বলেন, ‘মঞ্জুর পুড়ে মারা যায়নি। ধোঁয়ার কারণে দম বন্ধ হয়ে মারা গেছে। কক্ষের জানালাগুলো খোলা থাকলে হয়তো সে বেঁচে যেত।’