প্রতি নিশ্বাসে তাঁদের কথা মনে পড়ছে স্বজনদের

মাকসুদুর রহমান ও রুমকি রহমান। বনানীর আগুনে চিরতরে চলে গেছেন এই দম্পতি।  ছবি: সংগৃহীত
মাকসুদুর রহমান ও রুমকি রহমান। বনানীর আগুনে চিরতরে চলে গেছেন এই দম্পতি। ছবি: সংগৃহীত
>
  • স্বামী-স্ত্রী দুজন কাজ করতেন একই প্রতিষ্ঠানে
  • বনানীর এফ আর টাওয়ারের সেই অফিসে তাঁদের আর যাওয়া হবে না
  • নিহত ব্যক্তিদের পরিবার মুষড়ে গেছে শোকে

স্বামী–স্ত্রী দুজন কাজ করতেন একই প্রতিষ্ঠানে; হেরিটেজ ট্রাভেলস এজেন্সিতে। স্বামী মাকসুদুর রহমানের কর্মস্থল প্রতিষ্ঠানের বনানী শাখায়, স্ত্রী রুমকি রহমানের কর্মস্থল মতিঝিল শাখায়। এক মাসের জন্য রুমকিকে পাঠানো হয় বনানী শাখায়। বনানীর এফ আর টাওয়ারের সেই অফিসে তাঁদের আর যাওয়া হবে না। গত বৃহস্পতিবার আগুন লাগা সে ভবনের ভেতরে মারা যান রুমকি। আর তার (কেবল) বেয়ে নামতে গিয়ে নিচে পড়ে মারা যান মাকসুদ।

এফ আর টাওয়ারে আটকে পড়া ব্যক্তিদের অনেকে বের হয়ে আসতে পারলেও ২৫ জন মারা যান। নিহত ব্যক্তিদের পরিবার মুষড়ে গেছে শোকে। লাশ বাসায় ও গ্রামের বাড়িতে পৌঁছালে হৃদয়বিদারক অবস্থা তৈরি হয় স্বাভাবিকভাবে। ধোঁয়ায় শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাওয়া ফ্লোরিডা খানম, আনজীর আবিদ, মোস্তাফিজুর রহমান ও ইফতেখার হোসেনের পরিবারে সদস্যদের বুকে এখন সেই কষ্ট যেন চেপে বসেছে। প্রতি নিশ্বাসে তাঁদের কথা মনে পড়ছে স্বজনদের।

নিহত মাকসুদের বাবা মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। মা জেসমিন রহমান, বোন সুমাইয়া রহমানকে নিয়ে চলা তাঁর পরিবারে তিন বছর আগে যুক্ত হন স্ত্রী রুমকি। ছেলে ও ছেলের বউকে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ জেসমিন রহমান এখন শয্যাশায়ী। ভাই ও ভাবিকে হারিয়ে নির্বাক বোন সুমাইয়া।

গতকাল শুক্রবার মাকসুদের গেন্ডারিয়ার আলমগঞ্জের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, মা জেসমিন রহমান শুয়ে আছেন। চোখ দিয়ে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে। মায়ের পায়ের কাছে বসে আছেন সুমাইয়া। তাঁদের ঘিরে আছেন স্বজনেরা।

সুমাইয়া বলেন, ‘আগুন লাগার পরে ভাইয়া ফোন দিয়ে বলেছিল ভাবিকে খুঁজে পাচ্ছেন না। অনেক শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ধোঁয়ায় কিছু দেখা যাচ্ছে না। ছাদে যাওয়ারও উপায় নেই।’

তীব্র ধোঁয়ায় স্ত্রীকে খুঁজে না পেয়ে একসময় ভবনের বাইরের ঝুলন্ত তার (ক্যাবল) বেয়ে নামতে শুরু করেন মাকসুদুর রহমান। কিন্তু হাত ফসকে নিচে পড়ে মারা যান তিনি। রাতে এফ আর টাওয়ারের দশম তলা থেকে রুমকি রহমানের লাশ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা।

রুমকির বাবার বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলায়। রুমকির বাবা আশরাফ আলী বলেন, ‘দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ১২টা ৫০ মিনিটের মধ্যে দুবার মেয়ের সঙ্গে কথা হয়। প্রথমে সে আগুন লাগার কথা জানায় আর দ্বিতীয়বার বলে, বাবা, আমি আর বাঁচব না, আমার জন্য দোয়া করো।’ পরিবারের সিদ্ধান্তে মাকসুদুরকে ঢাকায় এবং রুমকিকে নীলফামারীতে দাফন করা হয়েছে।

ফ্লোরিডা খানম
ফ্লোরিডা খানম কাজ করতেন স্ক্যানওয়েল লজিস্টিক নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। ওই ভবনের ১১ তলায়। আগুন লাগার পরই স্বামী ইউসুফ ওসমানকে ফোন দিয়ে বাঁচার আকুতি জানান। স্ত্রীর ফোন পেয়ে মিরপুর রূপনগরের বাসা থেকে বনানী ছুটে যান ইউসুফ।

ফ্লোরিডা খানমের দেবর ইমানুয়েল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাইয়ার সঙ্গে ভাবির সর্বশেষ দুইটার দিকে কথা হয়। চিৎকার করে কাঁদছিলেন। শ্বাস নিতে পারছেন না বলে জানান। এরপর অনেকবার ফোন দিলেও ভাবি ধরেননি। রাতে তাঁর লাশ পাওয়া যায়। মোবাইল ফোন লাশের পাশেই ছিল।’

ফ্লোরিডা খানমের একমাত্র ছেলে ফয়সাল ওসমান স্নাতক শেষ করেছেন।

আনজীর আবিদ
আনজীর আবিদ এফ আর টাওয়ারের ১৫ তলায় মিকা সিকিউরিটিজে কাজ করতেন। দুপুরের পর থেকে তাঁর মোবাইল বন্ধ পাচ্ছিলেন স্বজনেরা। আনজীরের খোঁজে এফ আর টাওয়ারের সামনে জড়ো হন কয়েকজন স্বজন। বিভিন্ন হাসপাতালেও খোঁজ নেওয়া হয়। রাতে আনজীরের লাশ পাওয়া যায় ভবনের ভেতরে।

আনজীরের মামাতো ভাই আহসানুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, পরিবারের ছোট ছেলে আনজীর ঢাকায় বড় ভাইয়ের বাসায় থাকতেন। আনজীর ফোনে বাঁচার আকুতি জানিয়েছিলেন। একবার ফোন দিয়ে সবার কাছে দোয়াও চান। আনজীরের লাশ লালমনিরহাটের পাটগ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়েছে।

মোস্তাফিজুর রহমান
বিছানায় স্তব্ধ বসে ছিলেন জিনিয়া সুলতানা। স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান এফ আর টাওয়ারে অবস্থিত ইমপেয়ার অ্যাব্রেসিভ ইন্ডাস্ট্রিজে কাজ করতেন। মোস্তাফিজুরের জায়িম নামে সাড়ে চার বছরের একটি মেয়ে আছে।
মোস্তাফিজুরের লাশ গতকাল রংপুরের পীরগঞ্জের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। জিনিয়া সুলতানা বলেন, ‘শেষ কথা হয় বেলা দেড়টার দিকে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে বলে জানান।’

ইফতেখার হোসেন
কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ইফতেখার হোসেন একটি কুরিয়ার সার্ভিস অফিসে কাজ করতেন। আগুন লাগার সময় ভবনের ১১ তলা থেকে স্ত্রী আশা খাতুনকে ফোন দিয়েছিলেন তিনি। ইফতেখারের চার বছরের একটি ছেলে আছে।
গতকাল আশা খাতুন বলেন, ‘আগুন চারদিকে ছড়িয়ে গেছে জানিয়ে বাঁচার আকুতি জানায়। একটু পরে মোবাইল বন্ধ পাই।’ কথা বলতে বলতেই অচেতন হয়ে পড়েন আশা। প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন রংপুর ও কুষ্টিয়া প্রতিনিধি