একজন সাহেব আলী ও তাঁর শিশু বিনোদন কেন্দ্র

ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, ১৫ আগস্টের হৃদয়বিদায়ক ঘটনার ভাস্কর্য তৈরি করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন নির্মাণশ্রমিক সাহেব আলী। সম্প্রতি তোলা ছবি।  প্রথম আলো
ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, ১৫ আগস্টের হৃদয়বিদায়ক ঘটনার ভাস্কর্য তৈরি করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন নির্মাণশ্রমিক সাহেব আলী। সম্প্রতি তোলা ছবি। প্রথম আলো

বাড়ির নাম ‘শিশু বিনোদন কেন্দ্র’। সেখানে আছে ৩৭টি ভাস্কর্য। সেসব ভাস্কর্যে উঠে এসেছে ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি জাতির ওপর পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরতা, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কথা।

পটুয়াখালী সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নের বড় আউলিয়াপুর গ্রামে এই বাড়ি। ভাস্কর্যের নির্মাতা রাজমিস্ত্রি মো. সাহেব আলী (৫২)। এসব ভাস্কর্য নির্মাণ করতে গিয়ে ১৪ কড়া (আড়াই শতাংশে এক কড়া) জমির ৮ কড়া বিক্রি করে দিতে হয়েছে। ৩৭টি ভাস্কর্য তৈরি শুরু করলেও ৩৩টির কাজ শেষ হয়েছে। অর্থের অভাবে বাকিগুলোর কাজ এগোচ্ছে না।

কীভাবে এ কাজ করার অনুপ্রেরণা পেলেন? সাহেব আলী বলেন, বয়স যখন আট বছর, তখন তাঁর বাবা মারা যান। বড় ভাইয়ের আর্থিক অভাব-অনটনের সংসারে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর আর পড়া হয়নি। উপার্জনের পথে পা বাড়ান। জীবিকার তাগিদে চলে যান মুন্সিগঞ্জে। সেখানে ২৬ বছর কখনো রাইস মিলে, আবার কখনো রাজমিস্ত্রির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। মুন্সিগঞ্জের মুক্তা রাইস মিলে কাজ করার সময় পরিচয় হয় নাসিমা আক্তার নামের এক বীরাঙ্গনার সঙ্গে। তিনিও রাইস মিলের শ্রমিক ছিলেন। একসঙ্গে কাজ করার সুবাদে নাসিমার সঙ্গে তাঁর কথা হতো। নাসিমা তাঁর কাছে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার করুণ কাহিনির কথা বলেন। এসব শুনে তরুণ সাহেব আলী স্বাধীনতার মর্ম বুঝতে পারেন। তখন থেকেই মনে মনে কল্পনা করতে থাকেন মুক্তিযুদ্ধের এসব বিষয় নিয়ে ভাস্কর্য নির্মাণ করার। কিন্তু সাহেব আলীর সেই স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে যায় চার যুগের মতো।

১৯৮৯ সালে সাহেব আলী খান বিয়ে করেন। জীবিকার তাগিদে ২০০৬ সালে পাড়ি দেন দেশের বাইরে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুবাইয়ে তিন বছর চাকরি করার পর দেশে ফিরে আসেন ২০০৯ সালে। নিজ গ্রামে বাড়িঘর তৈরি করে স্ত্রী–পুত্রদের নিয়ে সংসার শুরু করেন। এখনো রাজমিস্ত্রির কাজ করে উপার্জন করেন। নিজের জমানো টাকা দিয়ে বড় আউলিয়াপুর গ্রামে ১৪ কড়া জমি কেনেন। এর মধ্যে ৮ কড়া জমির ওপর একটি বাড়ি করেন। স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে তাঁর চারজনের সংসার। এর মধ্যে ছোট ছেলে মো. হোসেন আলী খান অসুস্থ। দুর্ঘটনায় তার একটি পা ভেঙে যায়।

সাহেব আলী বলেন, দেশে ফিরে আসার পর আবারও ভাস্কর্য নির্মাণের চিন্তা মাথায় আসে। ২০১৭ সালে তাঁর বসতবাড়ির খোলা জায়গায় শুরু করেন ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ। ভাস্কর্য নির্মাণের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। রাজমিস্ত্রির কাজ করে যতটুকু শিখেছেন, তা দিয়েই ভাস্কর্য নির্মাণ করছেন। বায়ান্নর মহান ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭৫–এর ১৫ আগস্ট—এই সংখ্যাগুলো দিয়ে প্রথমে কাজ শুরু করেন। এরপর অন্যান্য ভাস্কর্য তৈরি করেন। আরও আছে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ভাস্কর্য, মাওলানা ভাসানী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক প্রমুখের ভাস্কর্য।

সাহেব আলীর তৈরি এসব ভাস্কর্য দেখার জন্য প্রতিদিন নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোর ছুটে আসছে তাঁর বাড়িতে। সাহেব আলী জানান, এসব ভাস্কর্য নির্মাণ করতে গিয়ে ১৪ কড়া জমির মধ্যে ৮ কড়া বিক্রি করে দিতে হয়েছে। ৩৭টি ভাস্কর্য তৈরির কাজ শুরু করলেও ৩৩টির নির্মাণকাজ শেষ করতে পেরেছেন। তবে তাঁর পরিকল্পনা রয়েছে ৭১টি ভাস্কর্য নির্মাণ করা। কিন্তু অর্থের অভাবে কাজ এগোচ্ছে না। সরকারিভাবে তাঁকে একটু সহায়তা করলে তিনি তাঁর স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেন।