ধুলা ও আওয়াজের মধ্যে চলছে চিকিৎসাসেবা

চরফ্যাশন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চলছে উন্নয়ন কাজ। ছবিটি গতকাল তোলা।  প্রথম আলো
চরফ্যাশন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চলছে উন্নয়ন কাজ। ছবিটি গতকাল তোলা। প্রথম আলো

চারদিকে সব এলোমেলো। ভবনে সংস্কারকাজ চলছে। ধুমধাম শব্দ হচ্ছে। ধুলা উড়ছে। দরজা-জানালা ভাঙা। ইটের টুকরা উড়ে এসে পড়ছে। মিস্ত্রি সেখানে সিমেন্ট-বালু গোলাচ্ছেন। এর মধ্যেই রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসকও।

ভোলার চরফ্যাশন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নির্মাণাধীন ভবনে রেখে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। চরফ্যাশন উপজেলায় ২০টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা। লোকসংখ্যা প্রায় ছয় লাখ। সবার চিকিৎসার ভরসাস্থল এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।

স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী নুর মোহাম্মদ বলেন, চরফ্যাশন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ১০০ শয্যায় উন্নীত হচ্ছে। নতুন করে হাসপাতাল ভবন, নার্স ডরমিটরি, গ্যারেজ কাম ড্রাইভার কোয়াটার, ডক্টরস কোয়ার্টারের বর্ধিতকরণ ও পুরোনো হাসপাতাল সংস্কারকাজ হচ্ছে। এসব কাজের কার্যাদেশ হয়েছে ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি। শেষ হবে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর। ২১ কোটি ৫৯ লাখ টাকার এ কাজটি এএমএলএমই (জেবি) মাজেদা এন্টারপ্রাইজ বাস্তবায়ন করছে। ঠিকাদার তিন মাস দেরিতে কাজ শুরু করেছেন।

২৫ মার্চ সকাল নয়টায় চরফ্যাশন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের প্রবেশপথ থেকে ছড়িয়ে আছে বালু-পাথর। হাসপাতাল চত্বরে চলছে কয়েকটি ভবন নির্মাণের কাজ। প্রধান ফটক থেকে কয়েকটি ভবন অতিক্রম করে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ পাওয়া গেল।

একটি ছোট পুরোনো ভবন। এ ভবনে প্যাথলজি বিভাগ, কফ পরীক্ষাগার ও জরুরি বিভাগ। কুঁড়েঘরের মতো চারটি কক্ষ। দুটি কক্ষ অন্ধকার, রোগী বসে আছে, কর্তব্যরত কেউ নেই। ভবনের বারান্দায় তিনজন রোগী বেডে শুয়ে আছে। আরেকটি টেবিলে গজ, ফিতা, কাঁচি, অস্ত্রোপচারের সরঞ্জামে মাছি ভনভন করছে।

ভেতরে একটি কক্ষে একজন চিকিৎসা কর্মকর্তা রোগী দেখছেন। বাকি দুজন অন্য কাজে ব্যস্ত। একজন রোগী বলেন, তাঁকে ভোলায় পাঠানোর ব্যবস্থা হচ্ছে। তাঁর পা ভেঙে গেছে।

জরুরি বিভাগের ডান দিকের একটি তিনতলা ভবনের নিচতলায় আউটডোর। সেখানে সংস্কারকাজ চলছে। নিচতলায় চিকিৎসকের অনেকগুলো কক্ষ। ৯ জন চিকিৎসকের নাম আছে সেখানে। কিন্তু কোনো কক্ষে চিকিৎসক দেখা যায়নি। জানতে চাইলে একজন আয়া বলেন, চিকিৎসক ইনডোরে (আবাসিক) রাউন্ডে আছেন।

ভবনের দোতলায় উঠে দেখা যায়, সব এলোমেলো। একদিকে সংস্কারকাজ চলছে। ধুমধাম শব্দ হচ্ছে। ধুলা উড়ছে। ইটের টুকরা উড়ে এসে পড়ছে। এর মধ্যেই ১১ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। পাশের আরেক কক্ষে আটজন নারী রোগী। মেঝেতে ধুলাবালু। মিস্ত্রি সেখানেই সিমেন্ট-বালু গোলাচ্ছেন, দরজা-জানালা ভাঙা। তিনতলায় আরেক কক্ষে ৩৬ জন রোগী।

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শোভন কুমার বসাক বলেন, ৩০ শয্যার লোকবল নিয়ে হাসপাতালটি ১০০ শয্যায় উন্নীত হচ্ছে। কিন্তু লোকবল নেই। তাঁর উপজেলায় সব মিলিয়ে ৩৫ জন চিকিৎসকের পদ। কিন্তু আছেন দুজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও ছয়জন চিকিৎসা কর্মকর্তা। তাঁদের সঙ্গে আছেন দন্ত বিশেষজ্ঞ ও উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। এর মধ্যে একজন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আছেন। একজন ঢাকায় আছেন।

রোগীদের সঙ্গে আসা স্বজনেরা বলেন, একদিকে ভবনের সংস্কারকাজ হচ্ছে, পাশে রোগী শুয়ে আছে। ঠুসঠাস শব্দ আর ধুলাবালুতে রোগীর অবস্থা আরও খারাপ। তার ওপর চিকিৎসক নেই। নেই পর্যাপ্ত নার্স। চিকিৎসাসেবা কীভাবে চলবে?

উপজেলা কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন ১০ জন রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আবাসিকে চিকিৎসা হলেও রোগীর ভোগান্তির শেষ নেই। ধুলাবালু আর শব্দদূষণে রোগী আরও কাহিল হচ্ছে। চিকিৎসার কোনো পরিবেশ নেই। কমপ্লেক্স চত্বরে নির্মাণাধীন ৩টিসহ ১৩টি ভবন রয়েছে। বেশির ভাগ ভবন চিকিৎসক-নার্স ও তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দখলে। শতাধিক আবাসিক রোগীর জন্য একটি জরাজীর্ণ ভবন।

স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, হাসপাতালের একটি নতুন ভবন প্রায় নির্মাণ হয়ে গেছে। সেখানে বিদ্যুতের সংযোগ দিলে সাময়িকভাবে চিকিৎসাসেবার জন্য ভবনটি ব্যবহার করা যায়। তা ছাড়া ডক্টরস কোয়ার্টারে কয়েকজন চিকিৎসক থাকেন। সে ভবনটিও চিকিৎসাসেবার কাজে ব্যবহার করা যেত। কিন্তু তাঁরা তা করেননি।

সংস্কারকাজের মধ্যে রোগীর চিকিৎসা কেমন চলছে, জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, হাসপাতাল ভবনের টয়লেট সংস্কার চলছে। খালি ভবন না পাওয়ায় তাঁরাও খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে কাজ করছেন। এ ভবনের সংস্কারকাজ শুরু হওয়ার আগে তাঁরা সাত দিনের সময় চেয়েছিলেন রোগীদের সরানোর জন্য। কিন্তু ঠিকাদার কাজ শুরু করে দেন। পরে আর রোগীদের সরানো হয়নি।

স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী বলেন, ‘সেটা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ব্যাপার। আমাকে সংস্কারের অনুমতি দেওয়ায় আমি কাজ শুরু করেছি। আমার দোষ কী? সিভিল সার্জন ও বরিশাল বিভাগীয় পরিচালকের অনুরোধে চিকিৎসার মূল ভবন সংস্কারে হাত দিয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে জমির পরিমাণ কম। হাসপাতালের নামে জমি অধিগ্রহণ করতে দেরি হচ্ছে। এখনো বাড়তি জমি বুঝে পাননি। জমি না পাওয়ার কারণে যত্রতত্র নির্মাণসামগ্রী রাখা হয়েছে।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী মারুফ হোসেন বলেন, মূল ভবন (হাসপাতালের পুরোনো ভবন) সংস্কারের কথা ছিল সবশেষে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের অনুরোধে কাজের মাঝপথেই সেখানে হাত দিতে হয়েছে। এখন কাজ কবে নাগাদ শেষ হবে বলা যাচ্ছে না। সেখানে দুটি টয়লেট ব্যবহারের অনুপযোগী ছিল। সেটি ভেঙে ঠিক করে দেওয়াই গুরুত্বপূর্ণ। বাকি কাজ পরে করলেও চলত।