দুদকের গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বড় অংশই সরকারি কর্মী

গত তিন বছরে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের বড় অংশই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। আবার দুদকে আসা অভিযোগের মধ্যেও সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ বেশি।

দুদকের তথ্যমতে, সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতির যেসব অভিযোগ এসেছে, তার অর্ধেকের বেশি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। ভূমি প্রশাসন, আর্থিক খাত, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পাসপোর্ট, ভূমি প্রশাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ব্যাংক, ওয়াসা, বিদ্যুৎ, কাস্টমস এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বেশি পড়ছে দুদকে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের নেতৃত্বে বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেয় ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ। এই কমিশন গত তিন বছরে গ্রেপ্তার করেছে ৬৪১ জনকে। তাঁদের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীই ৩৬১ জন। এর বাইরে ব্যাংক ও বিমা কর্মকর্তা ১৪১, ব্যবসায়ী ৭৫, জনপ্রতিনিধি ৩১ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন।

২০১৮ সালের আগস্টে প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের খানা জরিপেও ঘুষ–দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ঘুষ লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৬৮৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। ওই জরিপের তথ্য অনুসারে দেশের সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। এর পরে রয়েছে যথাক্রমে পাসপোর্ট, বিআরটিএ, বিচারিক সেবা, ভূমি সেবা।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচকের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে দেশে দুর্নীতি বেড়েছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থান ছিল শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে ১৭তম। এ বছর তা হয়েছে ১৩তম। সরকারি দপ্তর তথা সেবা খাতগুলোতে দুর্নীতির বিস্তারের কারণেই দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান খারাপ হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ

দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য ভুক্তভোগীরা যাতে সরাসরি জানাতে পারেন, সে জন্য ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই দুদকের হটলাইন ‘১০৬’ চালু হয়। বিনা খরচে এবং যেকোনো মোবাইল বা টেলিফোন থেকে এই নম্বরে ফোন করে দুদককে দুর্নীতির তথ্য, অভিযোগ জানানো যায়। দুদক সূত্র বলছে, গত ২০ মাসে এই নম্বরে প্রায় ২১ লাখ অভিযোগ এসেছে।

এর বাইরে লিখিত অভিযোগ এসেছে প্রচুর। দুদকের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে ১৭ হাজার, ২০১৭ সালে ১৭ হাজার ৯৮৩টি অভিযোগ এসেছে। তার আগে ২০১৬ সালে ১৩ হাজার, ২০১৫ সালে ১০ হাজার ৪১৫ এবং ২০১৪ সালে ১২ হাজার ৫০০ অভিযোগ পেয়েছে দুদক। এসব অভিযোগের অর্ধেকের বেশি সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে।

দুদক বলছে, এসব অভিযোগের মধ্যে একটি বড় অংশ দুদকের তফসিলভুক্ত না হওয়ায় সেগুলো নিতে পারেনি তারা। তফসিলভুক্ত অপরাধগুলোর মধ্যে যেগুলো গুরুতর, সেগুলো অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু অপরাধের অভিযোগ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়ে সেগুলোর ওপর ব্যবস্থা নিয়ে দুদককে জানাতে বলা হয়েছে।

দুদকের কমিশনার (অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খান মনে করেন, ‘দুদকের কাজই হলো সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, ঘুষ–দুর্নীতি—এসব নিয়ে। তাই দুদকে সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বেশি আসা স্বাভাবিক। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতা বেশি হলেও পরিমাণের দিক থেকে অর্থাৎ বড় অর্থের দুর্নীতি বাইরে বেশি। সব সরকারি দপ্তরে দুদকের নজরদারি আছে। দুর্নীতি করে কেউ পার পেয়ে যাবেন, এটা আমরা মনে করি না।’

হটলাইনে (১০৬) পাওয়া অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে সংস্থাটি এই সময়ে অনেক সরকারি দপ্তরে হানা দিয়েছে। সংস্থার এনফোর্সমেন্ট ইউনিট গঠন করে সরকারি দপ্তরে অভিযান চালিয়ে তাৎক্ষণিক অনেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সরকারি হাসপাতাল, বিআরটিএ, তিতাস গ্যাস, ওয়াসা, রাজউক, বিমান, সিভিল এভিয়েশন, এলজিআরডি, পল্লী বিদ্যুৎসহ সরকারি দপ্তর ও সরকারি সেবা সংস্থার কার্যালয়ে অভিযান চালিয়েছে দুদকের এনফোর্সমেন্ট দল। দুদকের এনফোর্সমেন্ট দলের অভিযানে উদ্ধার করা হয়েছে সরকারি সংস্থার সিবিএ নেতাদের দখলে থাকা বিলাসবহুল গাড়িও।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এনফোর্সমেন্ট দলের অভিযানে বরখাস্ত হয়েছেন ৪০ জন সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারী। গ্রেপ্তার হয়েছেন ৪৫ জন। অবৈধভাবে নেওয়া ৭১ লাখ টাকা ফেরত পাওয়া গেছে।

গত তিন বছরে ৫০টি ফাঁদ পেতে ৫০ জন সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করেছে দুদক। দুদকের ফাঁদে পড়েছেন প্রকৌশলী, সাবরেজিস্ট্রার, ভূমি কর্মকর্তা, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, খাদ্য কর্মকর্তা, কাস্টমস কর্মকর্তা, রাজস্ব কর্মকর্তা, শিক্ষা কর্মকর্তা, আদালতের বেঞ্চ সহকারী, ওয়াসা কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধিসহ অনেকে।

এঁদের মধ্যে অন্যতম নৌপরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম ফখরুল ইসলামকে ঘুষের পাঁচ লাখ টাকাসহ নিজ দপ্তর থেকে দুদকের একটি দল গ্রেপ্তার করে ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই। পরের বছর এপ্রিলে এই দপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এস এম নাজমুল হককে ঘুষের পাঁচ লাখ টাকাসহ রাজধানীর সেগুনবাগিচার একটি হোটেল থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ফাঁদ পেতে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে আনসার কমান্ড্যান্ট আশিকুর রহমানকে এক লাখ টাকাসহ গ্রেপ্তার করা হয়।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, সরকারি খাতে সম্পদের ব্যবহার বেশি। এ জন্য অনিয়মের সুযোগও বেশি। সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকায় এর অপব্যবহারের সুযোগও বেশি। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর অন্য দেশগুলোতেও বেশি। অনিয়ম বা দুর্নীতি করলে সাজা পেতে হয়, এমন দৃষ্টান্ত কম বলেই দুর্নীতি বেড়েছে বলে ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন।



গ্রেপ্তার হয়েছেন আমলা, ব্যবসায়ী ও জনপ্রতিনিধি

তিন বছরে দুদকের গ্রেপ্তার তালিকায় আছেন শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা থেকে ব্যাংকার, ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি। অনুসন্ধান বা মামলা পর্যায়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।

দুদক আইন অনুসারে অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে দুদক কর্মকর্তারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ক্ষমতা ভোগ করেন। প্রয়োজনে অনুসন্ধান–সংশ্লিষ্ট সম্ভাব্য আসামি কিংবা মামলার পর আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেন।

২০১৬ সালেই গ্রেপ্তার করা হয় ৩৮৮ জনকে। আর ২০১৭ সালে ১৮২ জন, ২০১৮ সালে ৫৭ জন এবং ২০১৯ সালে এখন পর্যন্ত ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গত বছরের অক্টোবরে পাস হয় সরকারি কর্মচারী আইন, ২০১৮। এরপর দুদকের গ্রেপ্তার অভিযানে কিছুটা ভাটা পড়ে। ওই আইনে বলা হয়েছে, দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ফৌজদারি অপরাধ করলেও আদালতে অভিযোগপত্র গৃহীত হওয়ার আগে কোনো সরকারি কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে।

সরকারি চাকরি আইনে কর্মচারীদের গ্রেপ্তার করা যাবে কি যাবে না, সেই বিতর্কের মধ্যেও ১০ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের রাজস্ব কর্মকর্তা (প্রশাসন) নাজিম উদ্দিন আহমেদকে গ্রেপ্তার করে দুদক। অভিযানের সময় কাস্টম হাউসের নিচতলায় তাঁর কক্ষের স্টিলের আলমারি খুলে ৬ লাখ টাকা উদ্ধার করেন দুদকের কর্মকর্তারা। কাস্টম কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে এই টাকা জব্দ করা হয়। এর কিছুদিন পর ২৪ জানুয়ারি দুদকের এক কর্মকর্তাকে ঘুষ দিতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন আনসার-ভিডিপির জেলা কমান্ড্যান্ট মো. আশিকুর রহমান।

গত তিন বছরে দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন ফারমার্স ব্যাংকের নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী (বাবুল চিশতী), এবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এম ওয়াহিদুল হক, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী আছির উদ্দিন, কেয়া কসমেটিকসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল খালেক পাঠান, সিটিসেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহবুব চৌধুরী, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল উদ্দিন চৌধুরী, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী এমদাদুল ইসলাম, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালযের প্রক্টর ও উপ–রেজিস্ট্রার এইচ এম তায়েহীদ জামান, পারটেক্স গ্রুপের পরিচালক শওকত আজিজ রাসেল, সড়ক ও জনপথের এস্টেট ও আইন কর্মকর্তা মিজানুর রহমান (উপসচিব), ভাসাভি ফ্যাশনের এমডি কামাল জামান মোল্লা, চেয়ারম্যান ইয়াসির আহমেদ খান, হল–মার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, মোংলা কাস্টম হাউসের সাবেক কমিশনার নূরুল ইসলাম, কোস্টগার্ডের সাবেক মহাপরিচালক শফিক উর রহমান, পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক মুনসী মুয়ীদ ইকরাম, অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এমডি মিজানুর রহমান খান প্রমুখ।