আদালতে খুনের বর্ণনা গ্রেপ্তার দুই শিক্ষার্থীর

শিক্ষক সাইফুর হত্যার দ্রুত বিচারের দাবিতে সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক অবরোধ। গতকাল দুপুরে এমসি কলেজের ফটকের সামনে।  প্রথম আলো
শিক্ষক সাইফুর হত্যার দ্রুত বিচারের দাবিতে সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক অবরোধ। গতকাল দুপুরে এমসি কলেজের ফটকের সামনে। প্রথম আলো
>

* মেয়েটি বলেছেন, তাঁর সঙ্গে জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন সাইফুর
* এই ক্ষোভ থেকে হত্যা করেছেন

সিলেটে শিক্ষক মো. সাইফুর রহমান (২৯) হত্যাকাণ্ডের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এমসি কলেজের এক ছাত্র ও ছাত্রীকে গ্রেপ্তার করেছে দক্ষিণ সুরমা থানার পুলিশ। ওই দুজন গতকাল সোমবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাতে মেয়েটি বলেছেন, তাঁর সঙ্গে জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন সাইফুর। এই ক্ষোভ থেকে তাঁকে ডেকে এনে হত্যা করেছেন। তবে সাইফুরের স্বজন ও বন্ধুরা বলছেন, খুনের ঘটনা ধামাচাপা দিতে তাঁরা জবানবন্দিতে এমন কথা বলেছেন।

দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি খায়রুল ফজল প্রথম আলোকে বলেন, গত রোববার সাইফুরের লাশ উদ্ধারের পরপরই তদন্তে নামে পুলিশ। তদন্তে এমসি কলেজের এক ছাত্রীর সঙ্গে শিক্ষক সাইফুরের সম্পর্ক নিয়ে বিরোধের বিষয়টি উঠে আসে। এরই সূত্র ধরে ওই ছাত্রী ও মোজাম্মিল হোসাইন নামের তাঁর সহপাঠীকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়েছিল। তাঁরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাইফুর হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। এরপর রোববার রাতে সাইফুরের মা রনিফা বেগম এ দুজনকে আসামি করে থানায় হত্যা মামলা করেন। গতকাল বিকেলে দুজনকে আদালতে হাজির করা হয়। তাঁরা সিলেট মহানগর বিচারিক হাকিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

সিলেট মহানগর পুলিশের ‘মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিটি সার্ভিস’ গতকাল সন্ধ্যায় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। তাতে সাইফুর খুনের ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মাথায় হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও হত্যার কারণ উদ্‌ঘাটিত হয়েছে বলে জানানো হয়।

গ্রেপ্তার দুজনের জবানবন্দির বরাত দিয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ছাত্রীটির মতের বিরুদ্ধে তাঁর সঙ্গে একাধিকবার শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন শিক্ষক সাইফুর। বিভিন্ন সময়ে শারীরিক সম্পর্কের সময় ধারণকৃত ভিডিও, স্থিরচিত্র, মিথ্যে কাবিননামা প্রকাশসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের জানিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় প্রতিশোধপরায়ণ হয়েই এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।

পুলিশ সূত্র বলছে, গ্রেপ্তার হওয়া মোজাম্মিল ও তাঁর সহপাঠী ছাত্রীটি অভিন্নভাবে খুনের কারণ ও হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়েছেন। জবানবন্দি মোতাবেক শিক্ষক সাইফুর রহমান এমসি কলেজ থেকে পড়াশোনা করেন। ওই কলেজের ছাত্র থাকাকালে শাহপরান এলাকার এক বাসায় ‘লজিং’ ছিলেন। ওই বাসার এক ছাত্রীকে পড়াতেন; খাওয়াদাওয়া করতেন সেখানে। মেয়েটি বর্তমানে এমসি কলেজের ছাত্রী। নানাভাবে ফুসলিয়ে একপর্যায়ে জোরপূর্বক তাঁর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন শিক্ষক সাইফুর। এতে ক্ষুব্ধ হয়েই তিনি সাইফুরকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন।

পরিকল্পনা মোতাবেক শিক্ষক সাইফুরকে শনিবার এমসি কলেজে ডেকে নেন ছাত্রীটি। সেখানে তাঁকে ঘুমের ওষুধমিশ্রিত সেমাই খাওয়ান। পরে দুজন সোবহানীঘাট এলাকার একটি আবাসিক হোটেল ওঠেন স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে। সেখানে ঘুমকাতুর অবস্থায় সাইফুরকে গলায় রশি পেঁচিয়ে হত্যা করেন ছাত্রীটি। এরপর সহপাঠী মোজাম্মিলের সহযোগিতায় মরদেহ দক্ষিণ সুরমা থানা এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে ফেলে আসেন।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও দক্ষিণ সুরমা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শিপলু চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল বিকেলে গ্রেপ্তার হওয়া দুজন সিলেট মহানগর তৃতীয় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। আদালতের বিচারক সাইফুর রহমান দুজনের জবানবন্দি ১৬৪ ধারায় রেকর্ড করেন। জবানবন্দি গ্রহণের পর দুজনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

তবে জবানবন্দিতে দেওয়া খুনের কারণের বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করছেন নিহত সাইফুরের সহপাঠী ও আত্মীয়স্বজন। তাঁদের ভাষ্য, শাহপরান এলাকার যে বাসায় গত পাঁচ বছর সাইফুর লজিং মাস্টার হিসেবে ছিলেন, সেখানে গ্রেপ্তার হওয়া ছাত্রীকে তিনি পড়াতেন এবং দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সম্প্রতি ছাত্রীটি অন্য একটি সম্পর্কে জড়ানোয় সাইফুর ক্ষুব্ধ হন। এতে উল্টো সাইফুরকে প্রেমিককে নিয়ে ছাত্রীটি হুমকি-ধমকি দিয়েছিলেন। বিষয়টি নিয়ে সাইফুর অনেকটা ভীতসন্ত্রস্ত ছিলেন। সাইফুরের ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু, একজন আত্মীয় এবং পুলিশে কর্মরত এক বন্ধু প্রথম আলোকে এ তথ্য জানিয়ে বলেন, খুনের ঘটনা ধামাচাপা দিতে গ্রেপ্তার হওয়া মোজাম্মিল এবং ওই ছাত্রী জবানবন্দিতে এমন কথা বলেছেন।

এ ব্যাপারে তদন্ত কর্মকর্তা শিপলু চৌধুরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, দুজনের দেওয়া জবানবন্দি নিয়েও পুলিশ তদন্ত করে সত্য-মিথ্যা বের করবে।