বড় প্রকল্প সময়ে শেষ করাই বড় চ্যালেঞ্জ

পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়েছে সবচেয়ে বেশি। দৃশ্যমান ঢাকার মেট্রোরেল। মহেশখালীতে তৈরি হয়েছে এলএনজি টার্মিনাল। প্রায় ১০ বছরে সরকারের অগ্রাধিকার ১০ প্রকল্পের তিনটির চিত্র এ রকমই। অবশ্য এই তিন প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে অনেক বেশি, সময়ও লেগেছে বেশি। এতে এসব প্রকল্পের অর্থনৈতিক উপযোগিতাও কমছে। বাকি সাত প্রকল্পের কাজ তেমন আগায়নি।

অগ্রাধিকারের প্রকল্পগুলোকে ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ নাম দেওয়া হলেও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়নি। ১০ বড় প্রকল্পের মধ্যে সাতটি প্রকল্পে চলতি অর্থবছরের মূল এডিপিতে ২৮ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আবার বরাদ্দ দিলেও খরচ করা যাচ্ছে না। অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) খরচ হয়েছে মাত্র ৯ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের মাত্র ৩৫ শতাংশ।

পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ছাড়া বাকি সাত প্রকল্পের কাজ এখন পর্যন্ত এক-তৃতীয়াংশও শেষ হয়নি। এই অবস্থায় নির্ধারিত সময়ে এবং অর্থে প্রকল্পগুলো শেষ করাই হবে সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া অগ্রাধিকারের বেশ কিছু প্রকল্প নিয়ে দেশের মধ্যে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উদ্বেগ ও সমালোচনা রয়েছে। এর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে পরিবেশসহ নানা ঝুঁকির কথাও বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এই উদ্বেগ ও ঝুঁকি দূর করাও হবে সরকারের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ।

বড় প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময় ও অর্থে শেষ না হওয়ার পেছনে নানা কারণের কথা বলেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে আছে প্রকল্প কর্মকর্তাদের দক্ষতার অভাব; এডিপিতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ না দেওয়া; দরপত্রপ্রক্রিয়া শেষ করে মূল কাজ শুরু করতে বিলম্ব; হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা–পরবর্তী পরিস্থিতিসহ নানা ধরনের কারিগরি সমস্যায় মাঝপথে কাজের শ্লথগতি ইত্যাদি। আরেকটি বড় অভিযোগ হচ্ছে, নানা কারণ দেখিয়ে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো। এর পেছনে অদক্ষতার পাশাপাশি অর্থের অপচয় ও অপব্যবহারের প্রবণতাকেও অনেকে দায়ী করেন।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম বড় ১০ প্রকল্প নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, এসব প্রকল্প যদি দ্রুত শেষ না হয়, তবে ১০ শতাংশ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে না। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের প্রাধান্য ও মনোযোগ একবিন্দুও কমেনি। তবে বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রকল্প একদম সময়মতো শেষ হবে—এটা আশা করা যায় না। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমার একটু হেরফের হতেই পারে।

বেশি অগ্রগতি পদ্মা সেতুতে, রেলে কম

২০০৯ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পে শুরুতে রেল সংযোগ ছিল না, পরে তা সংযোজন করা হয়। নকশা পরিবর্তনসহ নানা কারণে দু-তিন বছর সময় চলে যায়। এরপর দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে সরে যায়। পরে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। এসব জটিলতা কাটিয়ে মূল সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে। এরপর ২০১৭ সালে নদীর গভীরতার কারণে সেতুর ১৪টি পিলারের নকশা পরিবর্তন করা হয়।

২০০৭ সালে ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পেয়েছিল। আর দফায় দফায় ব্যয় বাড়ানোর পরে এখন তা দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পের ৬৩ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে, যা সরকারের অন্য সব অগ্রাধিকারের প্রকল্পগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে কথা ছিল ২০১৮ সালে প্রকল্পের উদ্বোধন হবে। তারপর করা হয় চলতি বছরের ডিসেম্বর মাস। কিন্তু সে সম্ভাবনাও নেই বলে সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে।

পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগে আরেকটি প্রকল্প আছে। রেল দিয়ে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বিশেষ করে খুলনা পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০১৬ সালের মে মাসে রেল সংযোগ প্রকল্প পাস হওয়ার পরে গত আড়াই বছরে অগ্রগতি মাত্র ২৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ। জমি অধিগ্রহণ করতেই আড়াই বছর চলে গেছে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও ফরিদপুরে জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া এখনো চলছে।

দৃশ্যমান হচ্ছে মেট্রোরেল

এমনিতেই নগরবাসীর দুর্ভোগের শেষ নেই। দুর্ভোগের নতুন অনুষঙ্গ মেট্রোরেল প্রকল্প। তবে একদিন কাজ শেষ হবে, যানজট কমবে, চলাচল হবে দ্রুত—এই আশায় দুর্ভোগকে সঙ্গী করে চলছে নগরবাসী। ২০১২ সালে এই প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০২৪ সালের মধ্যে উত্তরা থেকে মিরপুর হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মিত হবে। এর মধ্যে ২০১৯ সালের মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ট্রেন চলাচল চালু করার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ এগোয়নি। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পিলার নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। উত্তরার কিছু অংশে স্প্যান বসানো শুরু হয়েছে। অন্যদিকে আগারগাঁও থেকে ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর ও শাহবাগ অঞ্চলের কাজ শুরু হয়েছে মাত্র।

রূপপুরে অগ্রগতি ১৪ শতাংশ

১ লাখ ১৩ হাজার ৯৩ কোটি টাকার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রাশিয়া ঋণ হিসেবে দিচ্ছে ৯১ হাজার কোটি টাকা। আর গত আড়াই বছরে কাজের অগ্রগতি মাত্র ১৪ শতাংশ। আবার প্রকল্পটির ঝুঁকি নিয়েও পরিবেশবাদীরা এখনো সোচ্চার।

মূলত, ২০০৯ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের আলোচনা শুরু হয়। প্রকল্পের অর্থায়নে ২০১১ সালে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি সই করে বাংলাদেশ। তবে এখন প্রশিক্ষণ, নির্মাণ ও পরিচালনায় বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারত। তাই বিদ্যুৎকেন্দ্রে নির্দিষ্টভাবে রাশিয়া ও ভারতের ভূমিকা কী, তা নিয়ে অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে। এই অস্পষ্টতা দূর করাও হবে আরেকটি চ্যালেঞ্জ।

হোলি আর্টিজানের প্রভাব মাতারবাড়ীতে

মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল ২০১৪ সালে। লক্ষ্য ছিল ২০২৩ সালের মধ্যে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটির কাজ শেষ হবে। কিন্তু সাড়ে চার বছরে প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ২১ শতাংশ।

২০১৬ সালে গুলশানের হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ঘটনার পরে এই প্রকল্প এলাকা থেকে বিদেশি প্রকৌশলীরা দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। এ জন্য সাত-আট মাস কাজ প্রায় বন্ধ ছিল। এরপর সরকার বিদেশি কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরিতে প্রায় ৫০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ করে। এরপরেই আবার কাজে গতি আসে।

কাজ শুরু হয়নি কক্সবাজারের রেলের

চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করা হবে। এক দফা ব্যয় বৃদ্ধির পর এখন এই প্রকল্পের ব্যয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা।

২০১০ সালে প্রকল্পটি পাস হওয়ার সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। আর শেষ করার কথা ছিল ২০১৩ সালের মধ্যে। কিন্তু সম্ভাব্যতা যাচাই, জমি অধিগ্রহণের আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করতেই সময় চলে যায়। এরপরে ২০১৬ সালে প্রকল্পের সংশোধনী এনে ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ানো হয়। একই সঙ্গে সিঙ্গেল গেজের পরিবর্তে এখন ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণ করা হবে।

সব মিলিয়ে পরিকল্পনার ত্রুটি, নতুন নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ—এভাবে সাত বছর পেরিয়ে যায়। এরপর জমি অধিগ্রহণ হয়। এখন রেলপথের সীমানা চিহ্নিত করার কাজ চলছে।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে পরিবেশের ঝুঁকি

বাগেরহাটের রামপাল উপজেলায় বাংলাদেশ–ভারত মৈত্রী সুপার থারমাল পাওয়ার প্রজেক্টটি রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র হিসেবে বেশি পরিচিত। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ও ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কোম্পানি (এনটিপিসি) যৌথভাবে বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী বিদ্যুৎ কোম্পানি লিমিটেড নামে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ১৬ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পে তিন-চতুর্থাংশের বেশি অর্থ ঋণ হিসাবে দিচ্ছে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক। ২০০৯ সালে শুরু হওয়ার পরে এই প্রকল্পে ২০১৮ সালের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সম্ভব হয়নি।

মূল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। আর ভূমি উন্নয়ন, কার্যালয়, দেয়াল নির্মাণের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে।

পায়রা সমুদ্রবন্দর

২০১৫ সালে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০২০ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু অর্ধেক কাজও শেষ হয়নি। তবে আগে নির্মাণ করা অবকাঠামো দিয়ে সীমিত পরিসরে এই বন্দরের কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, প্রকল্পটি সমাপ্ত হলেও বড় জাহাজ ভেড়ার মতো নাব্যতা থাকবে না। কেননা, বড় জাহাজ ভিড়তে কমপক্ষে ১৮ মিটার গভীরতা থাকতে হয়। কিন্তু পায়রাবন্দর চ্যানেলে কোথাও কোথাও সাড়ে চার মিটারের মতো নাব্যতা আছে। ফলে বন্দরটি সচল রাখতে সারা বছর নদী খনন করতে হবে, যা বেশ ব্যয়বহুল।

অন্য প্রকল্প

ফাস্ট ট্র্যাক বা অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যে আছে কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ। এই বন্দর নির্মাণের জন্য কারিগরি ও অর্থনৈতিক সমীক্ষা শেষ করেছে জাপানের প্যাসিফিক কনসালট্যান্ট ইন্টারন্যাশনাল (পিসিআই)। প্রাথমিকভাবে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) ভিত্তিতে নির্মাণ করার কথা থাকলেও এখন গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট (জিটুজি) পদ্ধতিতে নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। চীন, ভারত, যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশ প্রাথমিক আগ্রহ দেখিয়েছে। এর অগ্রগতি এই পর্যন্তই।

তবে চালু হয়েছে মহেশখালীর ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল। তৈরি ও পরিচালনা পদ্ধতিতে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি পুরো ভাসমান টার্মিনালটি এনে মূল গ্যাসের সংযোগ লাইনের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এই প্রতিষ্ঠান টার্মিনাল ভাড়া দিয়ে বিনিয়োগ তুলে নেবে। তাই এই প্রকল্প শেষ হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। তবে টার্মিনালটি পুরোনো, আয়ুষ্কাল মাত্র ১৭ বছর। ফলে দীর্ঘ মেয়াদে এর কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যবস্থাপনা ও তদারক করার জন্য দক্ষ কর্মকর্তার অভাব আছে বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালয়ের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বড় প্রকল্পে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পক্ষ থাকে, নানামুখী কাজ হয়। কিন্তু এসব কাজ সমন্বয় করার জন্য কোনো পক্ষ নেই। এ ছাড়া প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণেই অনেক সময় পেরিয়ে যায়। প্রকল্পের সময় বাড়লে ব্যয় বাড়ে, যা প্রকল্পের সুবিধা (রেট অব রিটার্ন) কমিয়ে দেয়।

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান

বিশেষজ্ঞ মতামত
প্রকল্পে বেশি অর্থ ও সময় বাড়লে ভালো ফল দেয় না


যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়িত না হওয়ায় সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সরকারদলীয় সাংসদ। করাই স্বাভাবিক। বিশ্বব্যাপী মেগা প্রকল্প (প্রকল্প ব্যয় ১০০ কোটি ডলারের বেশি) বাস্তবায়নে বিলম্ব ও ব্যয় বৃদ্ধি ঘটে থাকে। তবে এ বিলম্ব ও ব্যয় বৃদ্ধির হার বাংলাদেশে অস্বাভাবিক রকমের বেশি। এমনিতেই আমাদের দেশে প্রকল্প ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। উদাহরণস্বরূপ বিশ্বব্যাংকের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ভারত ও চীনে প্রতি কিলোমিটার চার লেন মহাসড়কের ব্যয় (জমি অধিগ্রহণ খরচসহ) ১১-১৬ লাখ মার্কিন ডলার, ইউরোপে ৩৫ লাখ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশে এ ব্যয় দুই থেকে তিন গুণ, অর্থাৎ ২৫-৭০ লাখ ডলার। ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে এ ব্যয় ঠেকেছে ১ দশমিক ১ কোটি ডলারে। শুধু অন্য দেশের তুলনায় নয়, প্রকল্পের মূল প্রাক্কলিত ব্যয় ও সময়ের তুলনায় আসল ব্যয় ও সময় অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ পদ্মা সেতুর ব্যয় বেড়েছে মূল প্রাক্কলনের তুলনায় প্রায় ২০০ শতাংশ এবং বর্তমান সময়ে অনুমিত বিলম্ব ৪ বছর, যা ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে। এ ছাড়া ইতিপূর্বে বাস্তবায়িত অনুরূপ প্রকল্পের তুলনায়ও ব্যয় অনেক বেশি। উদাহরণ হিসেবে যমুনা সেতু প্রকল্পের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটারের ব্যয় ছিল ১৫.৭ কোটি মার্কিন ডলার। আরš পদ্মা সেতুতে এসে এ ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রতি কিলোমিটারে ৫৯.৫ কোটি মার্কিন ডলার। বলা হবে, যমুনা সেতু বাস্তবায়ন করা হয়েছে ২০ বছর আগে। তাই বলে চার গুণ ব্যয় বৃদ্ধি রীতিমতো অস্বাভাবিক!

এখন কথা হলো, এমনটি হচ্ছে কেন? প্রথমেই আসছে প্রকল্প প্রণয়নে তাড়াহুড়া। প্রকল্প বাস্তবায়নে বছরের পর বছর দেরি হচ্ছে। প্রকল্প তৈরির জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয় না। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়। প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে এসে পদ্মা সেতুর নকশা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। শুধু কারিগরি দিক নয়, চুক্তির আইনগত বিষয়গুলোও সুস্পষ্ট নয়। তাই মাঝপথে এসে শুল্ক ও কর পরিশোধের দায় নিয়ে প্রশ্ন আসে। তা ছাড়া ঠিকাদার নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা তো আছেই। আমাদের দেশের এ ধরনের কারিগরি ও আইনগত দিক থেকে দুর্বল প্রকল্পের টেন্ডারে দুর্বল চীনা ও ভারতীয় ঠিকাদাররাই অংশগ্রহণ করে, যাদের ট্র্যাক রেকর্ড ভালো নয়। মনে রাখতে হবে, ১০০ কোটি ডলারের একটি প্রকল্পের প্রকল্প দলিল প্রস্তুতের ব্যয়ই এক-দুই কোটি ডলার। তাই নামী ও দক্ষতাসম্পন্ন কোনো কোম্পানি প্রকল্পের কারিগরি ও আইনগত দিকগুলোর বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে এসব টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে না। অথচ আমরা দেখেছি, প্রকল্প দলিল কারিগরি ও আইনগতভাবে সুষ্ঠু এবং ঠিকাদার নির্বাচনপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ হলে নামী ও দক্ষ কোম্পানিই অংশগ্রহণ করে এবং সময়মতো ও নির্ধারিত ব্যয়ে প্রকল্প সম্পন্ন হয়। যেমনটি হয়েছিল মেঘনাঘাট ৪৫০ মেগাওয়াট ও হরিপুর ৩৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্ষেত্রে। ফলে প্রকল্প দুটি থেকে আমরা বিদ্যুতের সর্বনিম্ন ট্যারিফ পেয়েছিলাম। বাংলাদেশে কম দামে বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হওয়ার ভিত্তিতে পাকিস্তানে নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হয়েছিল।

যেকোনো প্রকল্পের ঠিকাদার নির্ধারিত হওয়ার পর দ্বিপক্ষীয় একচেটিয়া ব্যবসার (বাইল্যাটারাল মনোপলি) উদ্ভব হয়। একদিকে সরকার এবং অন্যদিকে ঠিকাদার। এ ধরনের বাজারের পরিণতি নির্ভর করে পক্ষগুলোর শক্তির ওপর। সরকারের শক্তি এখানে নির্ভর করে দুটি বিষয়ের ওপর: ১. প্রকল্প বিষয়ে কারিগরি জ্ঞান; ২. প্রকল্পের কাজ বুঝে নেওয়ার ক্ষমতা ও আগ্রহ। আগেই বলেছি, প্রকল্প বিষয়ে আমাদের জ্ঞান সীমিত। ঠিকাদাররা এর সুযোগ নিয়ে প্রকল্প নির্মাণে বিলম্ব ও ব্যয় বৃদ্ধি দাবি করে। আমাদের প্রকল্প পরিচালকেরা অনেক ক্ষেত্রেই ঠিকাদারের পকেটে চলে যান। আবার এসব মেগা প্রকল্পের পেছনে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা থাকেন। তাঁরা ঠিকাদারের পক্ষে শুল্ক ও কর মওকুফ, ব্যয় বৃদ্ধি, সময় বাড়ানো—এসব বিষয়ে তদবির করেন এবং সফল হন। প্রকল্প পরিচালকেরাও তাঁদের ভয়ে থাকেন। তাই দেখা যাচ্ছে, সার্বিকভাবে সরকারে উপরিউক্ত দুর্বলতাগুলোর কারণেই মেগা প্রকল্পগুলোর অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধি ও বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটছে। বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে এসবই মূলত চ্যালেঞ্জ।

প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য হচ্ছে সামাজিক সম্পদ বৃদ্ধি করা। প্রকল্পের ব্যয় অপেক্ষা এর সুবিধা বেশি হলে সামাজিক সম্পদ বাড়ে। সুবিধার তুলনায় ব্যয় বেশি হলে সামাজিক সম্পদ কমে। শেষোক্ত ক্ষেত্রে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রকল্প ব্যয় ও বাস্তবায়নের সময় অস্বাভাবিকভাবে বাড়লে সামাজিক সম্পদ কমে। আমি আগেও বলেছি, উন্নয়ন প্রকল্প কোনো তাজমহল নয়। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে যোগাযোগের টানেলটি বাস্তবায়নে এতটাই ব্যয় বৃদ্ধি ও বাস্তবায়নে বিলম্ব হয়েছিল যে বলা হয়ে থাকে, এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ায় ব্রিটেনের ক্ষতি হয়েছে এবং এ প্রকল্প বাস্তবায়িত না হলেই ব্রিটেন আরও বেশি উপকৃত হতো।

লেখক: মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, সাবেক বিদ্যুৎ-সচিব ও বড় প্রকল্প বিশেষজ্ঞ