'অযোগ্য' প্রার্থী ও কোন্দলে হার আ.লীগের তিনজনের

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাঁচটি উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে দুটিতে আওয়ামী লীগের ও তিনটিতে দলটির ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। সাংসদদের প্রভাব, যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন না দেওয়া ও কোন্দলের কারণে তিনটিতে আওয়ামী লীগ জয়ী হতে পারেনি বলে অভিযোগ করেছেন প্রার্থী ও তাঁদের নেতা-কর্মীরা।

গত রোববার ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর, নাসিরনগর, সরাইল, আশুগঞ্জ ও নবীনগর উপজেলায় চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ভোট নেওয়া হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় কসবায় তিন প্রার্থী বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। একই কারণে আখাউড়ায় শুধু ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন হয়। বাঞ্ছারামপুর ও বিজয়নগরে পঞ্চম ধাপে ভোট নেওয়া হবে।

নেতা-কর্মীরা বলেন, যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন না পাওয়ায় সদর ও সরাইল উপজেলায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী সুবিধা করতে পারেননি। নবীনগরে সাংসদের কারণে দলীয় প্রার্থীর ভরাডুবি হয়েছে। এ তিন উপজেলায় বিদ্রোহী প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন।

সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম এখানে দলীয় প্রার্থী ছিলেন। এখানে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য ফিরোজুর রহমান বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে লড়াই করেন। তিনি সুলতানপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) পাঁচবারের চেয়ারম্যান ছিলেন। সবার কাছে জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। তাই তিনি ৬৮ হাজার ২৩৩ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান হয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাহাঙ্গীর আলম পেয়েছেন ২৬ হাজার ৯০৭ ভোট।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা আওয়ামী লীগের তিন-চারজন নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ থেকে ফিরোজুর রহমানের মনোনয়ন পাওয়ার কথা ছিল। নানাভাবে তিনি প্রভাবশালী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সরাসরি যাওয়ার সুযোগ তাঁর রয়েছে। দলীয় প্রার্থী নিয়ে নেতাদের মধ্যে বিরোধ ছিল। এরপরও জাহাঙ্গীরকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নৌকার প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘ভোটের আগে বিভিন্ন জায়গা থেকে আমার কর্মী-সমর্থকদের গ্রেপ্তার করা হয়। ভোটের দিন কর্মী-সমর্থকদের কেন্দ্রে থেকে বের করে দেওয়া হয়। বিভিন্ন কেন্দ্রে আমার পাঁচ শতাধিক কর্মী আহত হয়েছেন। কাজীপাড়ার একটি কেন্দ্রে আমার নৌকার ভোটগুলো আনারসের সঙ্গে গণনা করেছে।’ এমন হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এর কারণ বলতে পারব না। আপনারাই দেখেন।’

সরাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শফিকুর রহমান এখানে দলীয় প্রার্থী। এখানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রফিক উদ্দিন ঠাকুর দলটির বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। নির্বাচনে রফিক উদ্দিন ৩০ হাজার ৭২৩ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান হয়েছেন। শফিকুর রহমান ১২ হাজার ৬১৬ ভোট পেয়ে চতুর্থ হয়েছেন।

কয়েকজন নেতা বলেন, এখানে যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তৃণমূলের কাছে তিনি ছিলেন অপরিচিত। এ কারণে তিনি প্রাপ্ত ভোটে নিকটতম প্রার্থীও হতে পারেননি।

জানতে চাইলে শফিকুর রহমান বলেন, ‘বেলা তিনটা পর্যন্ত সদরের কেন্দ্রগুলোয় চার থেকে পাঁচ শ করে ভোট পড়েছে। কিন্তু ফলাফলে দুই থেকে তিন হাজার করে ভোট পড়েছে বলে দেখানো হয়েছে। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’

নবীনগরে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপকমিটির সহসম্পাদক কাজী জহির উদ্দিন সিদ্দিক দলীয় মনোনয়ন পান। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। মনিরুজ্জামান ৪৯ হাজার ৮৭৮ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান হয়েছেন। কাজী জহির পান ৪৮ হাজার ৬৯০ ভোট।

আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, এখানে শুরু থেকে মনোনয়ন নিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগ ও স্থানীয় সাংসদ এবাদুল করিমের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। সাংসদ দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তিনি বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন।

কাজী জহির উদ্দিন সিদ্দিকী বলেন, ‘সাংসদ এবাদুল করিম আমার সাড়ে চার হাজার ভোট বাতিল করিয়েছেন। কেন্দ্র থেকে ফলাফল পরিবর্তন করিয়েছেন। একটি কেন্দ্রে স্বতন্ত্র প্রার্থী পেয়েছেন ১ হাজার ৪৯৬ ভোট; নৌকা ২ ভোট পেয়েছে। জয়ী প্রার্থী মাত্র এক হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। আমি পরাজিত হইনি।’

তবে জানতে চাইলে সাংসদ এবাদুল করিম বলেন, ‘নির্বাচনে সাংসদের ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই। আমি পুরোপুরি নীরব ছিলাম। কারণ প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়। একটা পক্ষ-বিপক্ষ শুরু হয়েছিল। আমি দলের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক নই। তাই বিষয়টি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছি। তবে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার জন্য বোঝানোর চেষ্টা করেছি। সবাই এক না হওয়ায় ব্যর্থ হয়ে আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি। সাংসদ মাঠে গেলে বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে বলে এলাকায়ই যাইনি। ভোট দিয়ে সকাল সাড়ে নয়টায় এলাকা ছেড়ে যাই। কীভাবে প্রভাব বিস্তার করলাম আর মাঠে কাজ করলাম?’

নাসিরনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রাফি উদ্দিন আহমেদ এখানে দলীয় প্রার্থী ছিলেন। তিনি ৫৯ হাজার ৪৬১ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ টি এম মনিরুজ্জামান সরকার ছিলেন বিদ্রোহী প্রার্থী। তিনি পেয়েছেন ১৪ হাজার ৫৭৪ ভোট।

আশুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক হানিফ মুন্সী দলীয় প্রার্থী ছিলেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আনিসুর রহমান এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। এখানে ৪৩ হাজার ৪১ ভোট পেয়ে হানিফ চেয়ারম্যান হয়েছেন। আনিসুর পেয়েছেন ২৫ হাজার ৫৫৫ ভোট।