চক্রাকারে চলছে বাস, নেই ঝামেলা নেই বাহাস

নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে যাত্রীরা লাইনে দাঁড়িয়ে ধানমন্ডি চক্রাকার বাসে উঠছেন। ছবি: সুহাদা আফরিন
নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে যাত্রীরা লাইনে দাঁড়িয়ে ধানমন্ডি চক্রাকার বাসে উঠছেন। ছবি: সুহাদা আফরিন

‘ভাড়া দেন, ভাড়া দেন’—বলে হাঁকডাক নেই। ভাড়া নিয়ে বাহাস বা বাগ্‌বিতণ্ডা নেই। টিকিট কেটে উঠতে হবে। হালকা মেজাজে গল্প করতে করতেই গন্তব্যে নামছেন যাত্রী। নামার সময় চালক সড়কের পাশে বাস থামিয়ে নিজেই দরজা খুলে দিচ্ছেন। সদ্য চালু হওয়া ধানমন্ডি চক্রাকার বাস সার্ভিসের এই চিত্র। সেবা নিয়ে যাত্রীরা সন্তুষ্ট, তবে মান ধরে রাখার ওপর জোর দেন তাঁরা।

বেলা দুইটা। ধানমন্ডির পুরোনো ১৫ নম্বরে লাল-সবুজ ছাতার নিচে চেয়ার-টেবিল পাতা একটি অস্থায়ী কাউন্টারে একজন টিকিট বিক্রি করছেন। আরেক সহযোগী সায়েন্স ল্যাব, নিউমার্কেট, আজিমপুর, পলাশী বলে যাত্রীদের ডাকছেন।

টিকিট কাটা হলো, গন্তব্য নিউমার্কেট। ভাড়া ২০ টাকা। প্রথমে একটি বাস এলেও সিট নেই, দাঁড়ানো যাত্রীও ছিল ভেতরে। অপেক্ষা পরের বাসের জন্য। এই ফাঁকে আলাপ হলো টিকিট কাউন্টারে বসা আমিনুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি গত রোববার থেকে ধানমন্ডির এই কাউন্টারে টিকিট বিক্রেতা হিসেবে কাজ করছেন।

তিন দিনে মানুষের সাড়া কেমন? আমিনুল হেসেই বলেন, ‘মাত্র তো শুরু হলো। তবে আমার কাউন্টারে মানুষ আসে। স্কুল ছুটির সময়ে লোকজন হয়।’ এরই মধ্যে কাউন্টার দেখে কৌতূহলবশত অনেকেই উঁকি দিয়ে টিকিট দেখেন। এক বাবা তাঁর স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে এলেন। যাবেন আজিমপুর। টিকিটের দাম শুনে এবং শিশু ও শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়া নেই বলে টিকিটি কেনেননি। টিকিট বিক্রেতা আমিনুল জানান, সবে শুরু। সবকিছু গুছিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে। অর্ধেক ভাড়াসহ সব ব্যবস্থাই চালু হবে।

১০ মিনিট পর আরেকটি বাস এল। সড়কের মধ্যে নয়, ঠিক একপাশে বাস থামল। টিকিট বিক্রেতার সহযোগী অপেক্ষারত যাত্রীদের আগেই উঠতে দেননি। বাস থেকে যাত্রী নামার পর তিনি বাকিদের উঠতে সাহায্য করেন। সিটগুলো চওড়া। হাঁটুর সঙ্গে সামনের সিট লেগে যায় না। এসি তো আছেই।

বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া সুমাইয়া জাহান নিউমার্কেট যাবেন। চক্রাকার বাসের অভিজ্ঞতা জানতে চাওয়া হলে বলেন, ‘আসলে এমন একটা বাসের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। ভাড়া দেওয়া নিয়ে ডাকাডাকি, হাউকাউ থাকবে না। টিকিট কেটে বাসে উঠব। নির্দিষ্ট গন্তব্যে নেমে যাব। বাসের মধ্যে পরিবেশ নষ্ট করার মতো কোনো ঝামেলা হবে না। পাবলিক বাস নিয়ে খুব বাজে অভিজ্ঞতা আছে। এই নিয়ে চক্রাকার বাসে তিনবার উঠলাম। সেবায় আমি সন্তুষ্ট। তবে সেবার মান ধরে রাখতে হবে। দুই দিন পর যেন আবার অন্য বাসের মতো না হয়। তাহলে আমাদের মতো লোকজন আর ওঠার সাহস করবে না।’

মোজাম্মেল হোসেন নিয়মিত মেয়েকে স্কুল থেকে বাসায় নিয়ে যান। মেয়ের স্কুল ধানমন্ডিতে। রিকশাই ছিল তাঁদের এই পথের বাহন। মোজাম্মেল বলেন, ‘মেয়েকে নিয়ে আমি বাসে উঠি না। কিন্তু এই বাস দেখে গতকাল মেয়েই বলে, বাবা, বাসটায় উঠে দেখি। দুই দিন হলো চড়ছি। এককথায় ভালো।’ তিনি জানান, এই বাসে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, বাচ্চাদের স্কুলে আনা-নেওয়া করা অভিভাবক, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী বা এই এলাকার মধ্যে কেনাকাটার জন্য যাঁরা বের হন, মূলত তাঁরাই চড়েন। উটকো ঝামেলা হবে না বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতেই একেকজন গন্তব্যে যাচ্ছেন। কাউন্টার ছাড়া যাত্রী তোলা হয়নি। তবে যাত্রী যেখানে নামতে চেয়েছেন, সেখানেই নামানো হয়েছে। বেলা আড়াইটায় বাসটি নিউমার্কেটে পৌঁছায়।

এই ২০ মিনিটের যাত্রার অভিজ্ঞতায় যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে দুই রকম মন্তব্য পাওয়া গেল। সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৩০ টাকা। কেউ মনে করছেন, এ বাস সেবার ভাড়া ‘একটু বেশি’। তবে বেশির ভাগ যাত্রী বলছেন, এটা বেশি না। এখানে আরামে যাতায়াত করা যাচ্ছে। অন্য বাসের সঙ্গে পাল্লা না দিয়ে সেবার মান কর্তৃপক্ষ ধরে রাখবে বলে যাত্রীরা আশা প্রকাশ করেন। এ ছাড়া ধানমন্ডি-নিউমার্কেট-আজিমপুরে প্রচুর রিকশা চলে। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যাও অনেক। যাত্রীরা আশা করেন, সেবা ঠিকমতো দিতে পারলে রিকশা ও ব্যক্তিগত গাড়ি-নির্ভরতা কমে আসবে।

গত ২৭ মার্চ রাজধানীর ধানমন্ডি-নিউমার্কেট-আজিমপুর সড়কপথে অত্যাধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) চক্রাকার বাসসেবা চালু হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন এর উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) এই চক্রাকার বাসসেবা পরিচালনা করছে।

মতিঝিল বাস ডিপোর ম্যানেজার মো. আশরাফুল আলম এ বাসসেবার দায়িত্বে আছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১১টি চক্রাকার বাস চলছে। দুই রুটে এখন পর্যন্ত চলছে—শংকর থেকে সাতমসজিদ রোড হয়ে নিউমার্কেট, আজিমপুর দিয়ে পলাশী এবং সোবহানবাগ থেকে মিরপুর রোড ধরে পলাশী চলাচল করে। সাতমসজিদ রুটে বেশি বাস চলে। সোবহানবাগ রুটে তিন থেকে চারটি বাস নিয়মিত চলে। এলিফ্যান্ট রোড, কাঁটাবনে রুটে এখনো চালু হয়নি।

এই ম্যানেজার জানান, চক্রাকার বাস সেবার জন্য তাঁদের ২৫টি বাস নামানোর কথা। এখনো সব বাস এসে পৌঁছায়নি। সব বাস পেলে বাকি রুটেও এ সেবা চালু হবে। এ ছাড়া মোহাম্মদপুর থেকেও যাত্রীদের চাহিদার কথা তাঁরা জেনেছেন। সে ক্ষেত্রে মোহাম্মদপুর থেকে আসাদগেট, এলিফ্যান্ট রোড হয়ে পলাশী পর্যন্ত একটি রুট এবং মোহাম্মদপুর থেকে জিগাতলা দিয়ে নিউমার্কেট-পলাশী রুটেও চালু করার কথা ভাবছে বিআরটিসি।

গড়ে কত যাত্রী বাসে ওঠে জানতে চাইলে আশরাফুল আলম বলেন, এখন পর্যন্ত বাসে প্রতি দিনে প্রায় ছয় থেকে সাত শ যাত্রী ওঠে। তবে এ সংখ্যা ওঠা-নামা করে বলে জানান। এ ছাড়া বলেন, মূল সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধ করে দিলে যাত্রী বাড়বে বলে আশা তাঁর।