দাকোপে খাল খননে দায়সারা ভাব

উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের (সিআইপি-১) আওতায় খুলনার দাকোপের ৩৩ নম্বর পোল্ডারে খাল খননের কাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, কোনোমতে দায়সারাভাবে খাল খনন করা হচ্ছে। কৃষকদের যে সুবিধার জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল, তার কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যাবে না বলে আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা।

খনন সঠিক ও যথাযথ না হওয়ায় কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানিয়ে গত ২৭ মার্চ দাকোপ ইউনিয়ন পরিষদের ১১ জন সদস্য প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী ও দলনেতা বরাবর আবেদন করেছেন। আবেদনের সঙ্গে তাঁরা এলাকার অন্তত ৩০০ মানুষের স্বাক্ষর যুক্ত করেছেন। আবেদনে তাঁরা লিখেছেন, মূল অংশে খননকাজ না করে খননযন্ত্র দিয়ে আঁচড়ে টেনে খালের পাড়ে স্লোপ করার চেষ্টা চলছে।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ব্যবস্থাপনায় চায়না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দ্য ফার্স্ট ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো অব হেনান ওয়াটার কনজারভেন্সি এই প্রকল্পের কাজগুলো করছে। নেদারল্যান্ডসের রয়েল হ্যাজকনিং ডিএইচভি এই প্রকল্পের উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান। অর্থায়ন করেছে বিশ্বব্যাংক।

প্রকল্পের খুলনা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপকূলীয় অঞ্চলের ছয়টি জেলায় মোট ১৭টি পোল্ডারে বাঁধ ও অভ্যন্তরীণ নিষ্কাশনব্যবস্থার উন্নয়ন এবং সেচ সুবিধার মাধ্যমে শস্য উৎপাদন বাড়ানোর উদ্দেশ্যে এই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৩ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। প্রকল্পের অংশ হিসেবে দাকোপের ৩৩ নম্বর পোল্ডারে পানিনিষ্কাশনের জন্য ১২টি করে ড্রেনেজ স্লুইস (ডিএস) নির্মাণ ও ফ্লাসিং স্লুইস (এফএস) নির্মাণ এবং ৬৩ দশমিক ২১ কিলোমিটার নিষ্কাশন খাল পুনঃখনন করা হচ্ছে। ১২টি খালের মধ্যে দুটি খাল খনন করা হয়েছে। এখন দাকোপ ইউনিয়নের কাটাখালী খাল (এফএস-৯) এবং দাকোপ খাল (ডিএস-৭) খননের কাজ চলছে। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের কাজ শেষের মেয়াদ ছিল গত ২৫ জানুয়ারি। যা বৃদ্ধি করে ২০২০ সালের ৩০ জুন করা হয়েছে। খুলনার দুটি ও বাগেরহাটের দুটি পোল্ডারের কাজ একটি প্যাকেজের আওতায় করা হচ্ছে। যার চুক্তিমূল্য ৬৯৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা।

নকশা অনুযায়ী, কাটাখালী খালটির তলদেশের প্রস্থ হবে ৪ দশমিক ১৫ মিটার, উপরিভাগে এটি হবে প্রায় ১৫ মিটার। গভীরতা হবে ২ দশমিক ৭ মিটার। তবে জলকপাটের কাছে এই মাপ থাকলেও আস্তে আস্তে বিলের ভেতর দিকে মাপ কিছুটা করে কমবে। খালটির ১ হাজার ১৩২ মিটার খনন করা হবে। দাকোপ খালটি খনন করা হবে প্রায় ৪ কিলোমিটার। জলকপাটের কাছে খালটির তলদেশ হবে ৭ দশমিক ১৫ মিটার এবং খালটির উপরিভাগ হবে ২৩ দশমিক ৭৫ মিটার। খালটি গভীরতা হবে ৩ দশমিক ৭৫ মিটার।

সরেজমিনে দেখা গেছে, খননযন্ত্রের সাহায্যে খাল খনন চলছে। কোনোমতে একটু মাটি খুঁড়ে তা পাড়ে তোলা হচ্ছে। স্থানীয়দের সহায়তায় মেপে দেখা যায়, নকশা অনুযায়ী সে মাপ হওয়ার কথা, তার অর্ধেকও হচ্ছে না। কাটাখালী খালে খননকাজ চলার সময় সেখানে বসে ছিলেন ওই এলাকার অন্তত ১০ জন কৃষক। তাঁরা জানান, এই খাল দিয়ে প্রায় দেড় হাজার বিঘা জমির পানি নিষ্কাশিত হবে। খালটি দীর্ঘ বছর অকেজো থাকায় আমন ছাড়া অন্য কিছু করা যায় না। খনন ভালো হলে এটা মিষ্টি পানির জলাধার হতো। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে, খনন করা না–করা সমান হচ্ছে।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় একজন কর্মী দেবদাস মণ্ডল বলেন, এলাকার বেশির ভাগ মানুষ খালটি কাটার পক্ষে। তবে এলাকার কয়েকজন এসে বারবার বাধা দিচ্ছে। তারা বলছে, এখানে খাল কাটা যাবে না, এই খাল বন্দোবস্ত নেওয়া। পরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় কাজ চলছে। অন্য একজন শ্রমিক বলেন, কোনোমতে খনন হচ্ছে, এ রকম খনন হলে মানুষের খুব লাভ হবে না।

স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, খালের বিভিন্ন অংশ দখল করে অনেকেই বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। কেউ আবার খালের বিভিন্ন অংশ বন্দোবস্ত নিয়ে ব্যবহার করছেন।

স্থানীয় ইউপি সদস্য সঞ্জয় জোয়াদ্দার প্রথম আলোকে বলেন, খাল খননের সময় স্থানীয় কয়েকজন বাধা দেয়। পরে স্থানীয় চেয়ারম্যান ও সবাই মিলে তাদের বোঝানোর পর তারা আর বাধা দেয়নি। তবে খাল খনন মোটেই ঠিকমতো হচ্ছে না।

দাকোপ খালটিতে এখনো পানি আছে; তার মধ্যেই খননকাজ চলছে। পাড়ের গেওয়াগাছগুলো উপড়ে ফেলা হয়েছে। খননযন্ত্র দিয়ে পাড়ে কিছু কিছু মাটি ফেলা হচ্ছে। দাকোপ ইউপির সদস্য দেবদাস গাইন বলেন, বিচিত্র রকমের খাল খনন চলছে। নামমাত্রও হচ্ছে তা–ও বলা যায় না। কোনোরকম মাটি না কেটে এক্সকাভেটর দিয়ে খালের কিছু মাটি টেনে পাড়ে লেপে সমান করে দেওয়া হচ্ছে।

দাকোপ ইউপির চেয়ারম্যান বিনয়কৃষ্ণ রায় বলেন, দাকোপ খালে নানা রকম অবৈধ স্থাপনা আছে, খালের মধ্যে পুকুর কাটা আছে। কাটাখালী খালে কিছু অংশ খাস বন্দোবস্ত দেওয়া। অবৈধ দখলদারেরা কাজে বাধা দিচ্ছে। জনগণের সঙ্গে প্রতিদিন ঝগড়া তো করা যায় না; এ জন্য কিছুটা সমঝোতা করতে হচ্ছে। না হলে তো প্রকল্পের কাজই বন্ধ হয়ে যাবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিআইডি-১ প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. আশরাফুল আলম বলেন, ‘আমরা এখনো খালগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে বুঝে নিইনি, কাজ শেষ হয়নি। উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান বিষয়গুলো তদারক করছে। নকশা অনুযায়ী আমরা তাদের কাছ থেকে বুঝে নেব। না হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টাকা পাবে না। তারপরও কাজের মান আরও ভালো করার জন্য বলা হয়েছে।