রমনায় আগ্রাসী গাছ বেশি

রমনা উদ্যানে অপরিকল্পিতভাবে বিদেশি আগ্রাসী প্রজাতির গাছ লাগানো হচ্ছে, যা জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি। গত বুধবার দুপুরে।  তানভীর আহাম্মেদ
রমনা উদ্যানে অপরিকল্পিতভাবে বিদেশি আগ্রাসী প্রজাতির গাছ লাগানো হচ্ছে, যা জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি। গত বুধবার দুপুরে। তানভীর আহাম্মেদ
>

• উদ্যান পুনর্বিন্যাসে পরামর্শ নিতে সমীক্ষা
• উদ্যানের ৬২% এলাকা বৃক্ষ আচ্ছাদিত
• ১১ শতাংশে নানা ভৌত অবকাঠামো
• মোট ৬০ প্রজাতির ৮৮১টি পাখি আছে
• ২৮৬৬ বড় বৃক্ষের বেশির ভাগ আগ্রাসী

রমনা উদ্যানে গাছের বড় অংশই এখন আগ্রাসী প্রজাতির। আছে বড় রেস্তোরাঁসহ অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো। দর্শনার্থীদের ফেলা ময়লা–আবর্জনাও চোখে পড়ার মতো।

সরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) পক্ষ থেকে রমনার জীববৈচিত্র্য ও ভৌত অবকাঠামো নিয়ে করা সমীক্ষায় এমন চিত্র উঠে এসেছে। উদ্যানটি পুনর্বিন্যাসের জন্য পরামর্শ নিতে গণপূর্ত অধিদপ্তরের সহায়তায় সমীক্ষাটি করা হয়েছে। গত বছর চূড়ান্ত হওয়া ওই সমীক্ষার মাধ্যমে এই প্রথমবারের মতো উদ্যানটির বৃক্ষ, পাখি, মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করা হয়েছে।

সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে রমনার জীববৈচিত্র্য কমে এলেও সেখানে যে পরিমাণ গাছ, পাখি ও প্রজাপতি আছে, তা রাজধানীর জন্য অনন্য। চন্দনা টিয়ার মতো পাখি আর দুলিচাঁপা, কুসুম, মালি আম ও মাধবীলতার নিরাপদ আবাস এই উদ্যান। রাজধানীর সবচেয়ে বড় এই উদ্যান মোগল আমলে স্থাপিত। বর্তমানে উদ্যানটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে গণপূর্ত অধিদপ্তর।

রমনার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও রমনা উদ্যানের সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের পরিচালক এ কে এম সোহরাওয়ার্দী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমীক্ষার সুপারিশগুলো আমলে নিয়ে কাজ শুরু করেছি। রেস্তোরাঁটি সরিয়ে ফেলার জন্য নোটিশ দেওয়া হবে এবং সেখানে একটি কফি কর্নার করা হবে।’

সমীক্ষায় বলা হয়েছে, উদ্যানের এক পাশে শাহবাগ থেকে মৎস্য ভবন পর্যন্ত ব্যস্ত সড়কের যানবাহনের শব্দ ও ধোঁয়ার দূষণ বৃক্ষ ও পাখিদের জন্য বিপদ ডেকে আনছে। লেকে শোল, পুঁটি, টাকি, রুই, শিং, কাতলা, ফলিসহ মোট ১৪ প্রজাতির মাছ রয়েছে। কিন্তু লেকের পানি দূষিত হয়ে পড়ায় মাছ ও ব্যাঙের দল বিপন্ন হয়ে পড়ছে।

সমীক্ষা দলের প্রধান ও সিইজিআইএসের গবেষক সৌরভ মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, উদ্যানটিতে বিভিন্ন সময় উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিতভাবে বিদেশি প্রজাতির ও একই জাতীয় গাছ লাগানো হয়েছে। রেস্তোরাঁ-সড়কসহ যেসব অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে, তার বেশির ভাগই উদ্যানের জীববৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু উদ্যানে এখনো নানা প্রজাতির পাখি, গাছ ও প্রজাপতি রয়েছে, যা রাজধানীর জীববৈচিত্র্যের জন্য একটি অনন্য স্থান হয়ে উঠতে পারে।

উদ্যানের ৬২ শতাংশ এলাকা বৃক্ষ আচ্ছাদিত, ১১ শতাংশে নানা ভৌত অবকাঠামো। মোট বৃক্ষ ৪ হাজার ৫৬২টি। যার মধ্যে ১৩ প্রজাতির ৯৩৮টি পামজাতীয় গাছ রয়েছে। ২ হাজার ৮৬৬টি বড় বৃক্ষ রয়েছে, যার বেশির ভাগ ইউক্যালিপটাস, রেইনট্রিসহ আগ্রাসী প্রজাতির। আগ্রাসী প্রজাতির গাছের কারণে উদ্যানটিতে লতাগুল্মের বিস্তার ঘটতে পারছে না। পাখিদের বসবাসের স্থান হিসেবে এই গাছগুলো খুব বেশি উপযুক্ত নয়।

উদ্যানটিতে মোট ৬০ প্রজাতির ৮৮১টি পাখি আছে। বেশির ভাগই পাতিকাক। এ ছাড়া আছে ময়না, প্যাঁচা, দোয়েল ও টিয়া পাখি। উদ্যানে ৬০ প্রজাতির প্রজাপতি, ১০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, সাত প্রজাতির সাপ, তিন প্রজাতির উভচর এবং ১৪ প্রজাতির মাছ রয়েছে।

রমনায় সড়ক ও পাকা বেঞ্চ, গাছের চারপাশে পাকা বেষ্টনীসহ নানা ধরনের অবকাঠামো যত্রতত্র বানানো হয়েছে। যার মোট সংখ্যা ১ হাজার ১১৬টি। পুরো উদ্যানটিতে মোট সড়ক ১০ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার। আছে শিশুদের খেলাধুলা ও প্রাতর্ভ্রমণকারীদের জন্য ব্যায়ামের অবকাঠামো। যেখানে সেখানে ডাস্টবিন স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু দর্শনার্থীরা সেখানে ময়লা ফেলে না।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, মোগল আমলে রমনা উদ্যান তৈরির সময় মূল পরিকল্পনা ছিল একে শহরের মধ্যে প্রকৃতিনির্ভর বন হিসেবে গড়ে তোলা। কিন্তু পর্যায়ক্রমে সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে নানা স্থাপনা। উদ্যানটি আদি চরিত্র হারিয়ে আস্তে আস্তে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একে বাঁচাতে হলে সমীক্ষার সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।

সমীক্ষা প্রতিবেদনে সুপারিশের মধ্যে রয়েছে রেস্তোরাঁটি সরিয়ে নেওয়া, আবর্জনা ফেলা ও সরানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা, দর্শনার্থীদের যাতায়াত সীমাবদ্ধ করা, অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো ভেঙে ফেলা, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, উদ্যানটি এক দিনের জন্য বন্ধ রাখা।

রমনা উদ্যান বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বের বেশির ভাগ বড় শহরে এ ধরনের উদ্যান থাকে। সেখানে সেই দেশের উপযোগী বৃক্ষ থাকে। কিন্তু রমনায় স্থানীয় প্রজাতির বৃক্ষ খুবই কম। আবহাওয়া ও প্রকৃতির অনুপযোগী বিদেশি আগ্রাসী প্রজাতির বৃক্ষ দিয়ে উদ্যানটি সাজানো হয়েছে। এতে উদ্যানটির বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। উদ্যানটি টিকিয়ে রাখতে তিনি বৃক্ষের পুনর্বিন্যাসের পরামর্শ দেন।