যন্ত্রপাতি-জনবল কিছুই যেন নেই সিসিইউতে

এক্সারসাইজ টলারেন্স টেস্ট বা স্ট্রেস টেস্ট (ইটিটি) যন্ত্রটি নষ্ট নয় বছর। ১২টি ইনফিউশন পাম্প থাকলেও সচল একটিও নেই। একটিমাত্র ইকো–কার্ডিয়াক যন্ত্র; সেটিও নষ্ট এক বছর ধরে। চারটি ইসিজি যন্ত্রের দুটিই অকেজো। নেই কোনো এনজিওগ্রাম যন্ত্র। শুধু তাই নয়, ২৮ শয্যার সিসিইউটির নেই নিজস্ব কোনো চিকিৎসক ও নার্স।

নষ্ট যন্ত্রপাতি আর ধার করা জনবল দিয়েই চলছে যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ)। যশোর মেডিকেল কলেজ এবং যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের অন্য বিভাগ থেকে চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারী এনে চালু রাখা হয়েছে সিসিইউটি। ২৮ শয্যার সিসিইউতে ভর্তি থাকছেন প্রতিদিন গড়ে ৭০ জন হৃদরোগী রোগী। এতে হৃদরোগীদের চিকিৎসাসেবা দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, খুলনা বিভাগের হৃদরোগীদের চিকিৎসার জন্য ২০০৬ সালের ১২ অক্টোবর এ হাসপাতালে ২৮ শয্যার সিসিইউ চালু করা হয়। জরুরি ওয়ার্ডে ছয়টি, পুরুষ ওয়ার্ডে ১৫টি, মহিলা ওয়ার্ডে পাঁচটি ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দুটি সংরক্ষিত শয্যা রয়েছে। ২০১০ সালের ২৯ জানুয়ারি সিসিইউর পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু হয়। চিকিৎসক, নার্সসহ ৮৯টি পদ সৃষ্টি করা হয়। এর মধ্যে ২ জন সিনিয়র কনসালট্যান্ট, চারজন জুনিয়র কনসালট্যান্ট, আটজন জরুরি চিকিৎসা কর্মকর্তা এবং ১২ জন চিকিৎসা কর্মকর্তা থাকার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো পদে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। হাসপাতালের অন্যান্য বিভাগ থেকে চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারী এনে কোনোমতে চালু রাখা হয়েছে বিশেষায়িত এই ইউনিট। সিসিইউতে নেই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ)। নেই এনজিওগ্রাম যন্ত্র। ফলে হৃদরোগীদের ঠিকমতো চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

গত ১৪ মার্চ দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, হাসপাতালের ওয়ার্ডের মেঝেতে শুয়ে আছেন যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার পাল্লা আজমপুর গ্রামের রহিমা বেগম (৭০)। হৃদরোগ ও হাঁপানির সমস্যা নিয়ে গতকাল তিনি ভর্তি হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘কোনো সিট পাইনি। এ জন্য হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে আছি। ডাক্তার এসে দেখে গেছেন। এখন একটু ভালো লাগছে।’

রহিমা বেগমের মতো ৪১ জন হৃদরোগীর ঠাঁই মিলেছে হাসপাতালের ওয়ার্ড ও বারান্দার মেঝেতে। আর শয্যায় রয়েছেন ২৮ জন। বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৪৫ জন।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, বর্তমানে সিসিইউটিতে যশোর মেডিকেল কলেজের দুজন সহযোগী অধ্যাপক, একজন সহকারী অধ্যাপক এবং যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের দুজন জুনিয়র কনসালট্যান্ট কর্মরত আছেন। এ ছাড়া হাসপাতালের অন্য বিভাগের পাঁচজন চিকিৎসা কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কর্মরত আছেন হাসপাতালের ১৬ জন নার্স এবং ১৪ জন কর্মচারী।

যশোরের চৌগাছা উপজেলার জলকা মাধবপুর গ্রামের সিরাজুল ইসলাম (৫৫) ১৩ মার্চ ভর্তি হন সিসিইউতে। তিনি বলেন, ‘সিট না পাওয়ায় বারান্দার মেঝেতে বিছানা পেতে আছি। বুকে ব্যথা আছে। তবে ডাক্তার মাঝে মধ্যে এসে খোঁজ নিচ্ছেন।’ যশোর সদর উপজেলার কাশিমপুর গ্রামের কুলসুম বেগম (৭০) বুকে ব্যথা অনুভব করায় ১৪ মার্চ সকালে হাসপাতালে ভর্তি হন। তিনি বলেন ‘সিট এখনো পাইনি। হাসপাতালের বারান্দায় আছি। ডাক্তারেরা জানিয়েছেন, খালি হলে সিট পাবো।’

জুনিয়র কনসালট্যান্ট মোহাম্মাদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘দুজন সহযোগী ও একজন সহকারী অধ্যাপক এবং আমরা মাত্র দুজন জুনিয়র কনসালট্যান্ট ছয়টি জেলার হৃদরোগীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছি। এ ছাড়া, হাসপাতালের পাঁচজন চিকিৎসা কর্মকর্তা আমাদের সঙ্গে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। প্রায় নয় বছর ধরে ইটিটি মেশিনটি নষ্ট। সবগুলো ইনফিউশন পাম্প নষ্ট হয়ে গেছে। চারটি ইসিজি মেশিনের দুটিই অকেজো। একটিমাত্র ইকো মেশিন প্রায় এক বছর ধরে নষ্ট। শুরু থেকে এ পর্যন্ত এনজিওগ্রাম যন্ত্র দেওয়া হয়নি। এর মধ্য দিয়ে ভর্তি এবং আউটডোর মিলিয়ে প্রতিদিন গড়ে ১০০ জন রোগীকে কাঙ্খিত সেবা দেওয়ার সাধ্যমতো চেষ্টা চালানো হচ্ছে।’

যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনারি কেয়ার ইউনিটে এক অর্থে কিছুই নেই। ডাক্তার নেই, জনবল নেই, নেই প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্র। যন্ত্র যা আছে তার কয়েকটি নষ্ট। রোগীর তুলনায় শয্যা সংখাও অনেক কম। আইসিইউ জরুরি। শয্যা সংখ্যা বাড়ানো দরকার।’ তিনি বলেন, ‘লোকবল নিয়োগ এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রের জন্য অনেকবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো লোকবল নিয়োগ ও যন্ত্র পাওয়া যায়নি। আশা করছি, খুব তাড়াতাড়ি লোকবল নিয়োগ করা হবে এবং যন্ত্র বরাদ্দ পাওয়া যাবে।’