লাশের চিহ্ন না রাখতে ভয়ংকর নৃশংসতা

তাঁরা দুজন বাল্যবন্ধু। একই রাজনৈতিক দলের কর্মীও। কিন্তু চাঁদাবাজির ভাগ–বাঁটোয়ারা ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে তাঁদের বিরোধ দেখা দেয়। বাসায় ডেকে এনে এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে খুন করেন। ঘটনা ধামাচাপা দিতে সন্ত্রাসী অমিত মুহুরী লাশটির চিহ্ন না রাখতে সবই করেছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। খুন হওয়া বন্ধুটি ছাত্রলীগের কর্মী ইমরানুল করিম।

দেড় বছর তদন্ত শেষে পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রে এসব বিষয় উঠে আসে। গত রোববার আদালতে দেওয়া অভিযোগপত্রে অমিতসহ নয়জনকে আসামি করা হয়। এটি গ্রহণের শুনানির জন্য এখনো তারিখ পড়েনি।

অমিতের সহযোগীরা হলেন ইমাম হোসেন ওরফে শিশির, শফিকুর রহমান, সিয়াম চৌধুরী, রাজীব কান্তি চৌধুরী, জিতু মুহুরী, রাকেশ মিত্র, জোবাইর আলম ও অমিতের স্ত্রী চৈতি মুহুরী। এদের মধে৵ অমিত কারাগারে। বাকিরা পলাতক। যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-অর্থবিষয়ক সম্পাদক হেলাল আকবর চৌধুরী ওরফে বাবরের অনুসারী অমিত। পুলিশ জানায়, অমিতের বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র ও চাঁদাবাজির ১৫টি মামলা রয়েছে। পূর্বাঞ্চল রেলের কোটি টাকার দরপত্র নিয়ে জোড়া খুনের মামলার আসামিও তিনি।

২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের এনায়েতবাজার এলাকার রানীরদিঘি এলাকা থেকে একটি ড্রাম উদ্ধার করে পুলিশ। প্রথমে বোমা রয়েছে ভাবা হলেও ড্রাম কেটে ভেতরে লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশ গলে যাওয়ায় তখন পরিচয় বের করা যায়নি। পরে এ ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে ৩১ আগস্ট ইমাম হোসেন ও শফিকুর রহমান নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা পুলিশকে বলেন, ড্রামের ভেতরে পাওয়া লাশটি অমিতের বন্ধু নগর যুবলীগের কর্মী ইমরানুল করিমের। ৯ আগস্ট নগরের নন্দনকানন হরিশ দত্ত লেনের নিজের বাসায় ইমরানুলকে ডেকে নেন অমিত। এরপর বাসার ভেতরেই তাঁকে হত্যা করা হয়।

ঘটনার শুরু থেকে মামলাটি তদন্ত করেন কোতোয়ালি থানার এসআই হারুন অর রশিদ। আদালতে দেওয়া এ মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, অমিত একজন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে অমিত ও ইমরানুলের মধে৵ বিরোধ ছিল। দুজন বাল্যবন্ধু ও একই রাজনৈতিক দলের কর্মী হলেও বিরোধের জেরে ইমরানুলকে কয়েক দফায় মারধরও করেন অমিত। ঘটনার আগে ৮ আগস্ট শিশিরের বাসায় অমিত, রাজীব, জিতু ও ইমরানুল আড্ডা দেন। একপর্যায়ে অমিত সেখান থেকে চলে আসেন। পরে শিশিরকে ফোন করে জানানো হয় যেভাবেই হোক ইমরানুলকে মেরে ফেলতে হবে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইমরানুলকে পরদিন শিশিরের মাধ্যমে অমিতের নন্দনকাননের বাসায় ডেকে আনা হয়। আসার পর ইমরানুলের হাত ও পায়ে ওড়না দিয়ে বেঁধে ফেলেন অমিতের স্ত্রী চৈতি। চেপে ধরেন শিশির। ওই সময় অমিত ছুরি দিয়ে ইমরানুলের মুখে ও সারা শরীরে আঘাত করেন। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর লাশটি বাসার বাথরুমে রাখা হয়।

অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়েছে, নগরের হাজারী গলি থেকে অ্যাসিড আনা হয়। পরিকল্পনামতো অ্যাসিড ও চুনাপাথর ড্রামের ভেতর ঢেলে দেওয়া হয়। এতে ইমরানুলের শরীর থেকে মাংসগুলো ঝরে যায়। নগরের কর্ণফুলী নদীতে ইমরানুলের হাড়গুলো ফেলার পরিকল্পনা ছিল আর মাংস বাথরুমে ঢালার। কিন্তু ঘটনার সময়ে মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ায় পরিকল্পনাটি বাতিল করা হয়। লাশের চিহ্ন না রাখতে ড্রামের মুখে সিমেন্ট ও বালি দিয়ে ঢালাই করে দেওয়া হয়। পরে ভ্যান গাড়িতে করে লাশভর্তি ড্রামটি নগরের রানীরদিঘিতে ফেলে দেওয়া হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার এসআই হারুন অর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, অমিতসহ নয়জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।

হত্যার ঘটনাটি ওই বছরের ৩১ আগস্ট জানাজানি হওয়ার পর অমিতকে ধরতে পুলিশ অভিযান শুরু করে। আর অমিত কৌশল নেন পুলিশকে বোকা বানানোর। মুঠোফোন পাঠিয়ে দেন বেনাপোলে। অথচ তিনি তখন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা ও কুমিল্লা ঘুরে আসেন। চুল, দাড়ি কেটে নিজের বেশভূষাতেও পরিবর্তন আনেন—যাতে পরিচিত লোকজনও তাঁকে প্রথম দেখাতেই চিনতে না পারেন। এ ছাড়া কৌশল হিসেবে কিছু দিনের জন্য ভর্তি হন কুমিল্লার একটি মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রে। অবশ্য এতে শেষ রক্ষা হয়নি। পরে ২ সেপ্টেম্বর তাঁকে কুমিল্লা থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

ইমরানুলের খুনিদের কঠোর শাস্তি দাবি করেছেন তাঁর ভাই ইরফানুল করিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাইকে ফিরে পাব না। কিন্তু বিচার যেন পাই।’