পাওনা টাকা না পেয়ে আখ উপড়ে ফেলছেন কৃষক

জয়পুরহাটের চিনিকলে আখ বিক্রির টাকা পাননি চাষিরা। ক্ষোভে-দুঃখে তাঁরা জমিতে লাগানো আখ উপড়ে ফেলেন। আখের বদলে জমিতে আবাদ করেন অন্য ফসল। এর ফলে আখের আবাদ কমে যাচ্ছে। আখের দাম পরিশোধের নিশ্চয়তা না পেলে আখের অভাবে চিনিকল বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছে চিনিকল কর্তৃপক্ষ।

চাষিরা বলেন, চিনিকলের কাছে আখচাষিদের পাওনা রয়েছে ১৬ কোটি টাকা। তিন মাস আগে তাঁরা আখ বিক্রি করেছেন, কিন্তু এখনো টাকা পাননি। তাঁদের সংসার চলে কীভাবে? যে ফসল বিক্রি করে দিনের পর দিন পাওনা টাকার জন্য ধরনা দিতে হয়, সে ফসল আবাদ না করাই ভালো। তাই আখ চাষ আর নয়। এ কারণে তাঁরা ধানের আবাদ করছেন। কিন্তু বোরো ধান আবাদে পানি সেচের টাকা, জমিতে ইউরিয়া সার দেওয়ার জন্য তাঁদের ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে।

জেলার চকজালাল গ্রামের কৃষক ইবনে আল মাসুদ শাহ। গত শনিবার দুপুরে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আখ বিক্রির প্রায় ছয় লাখ টাকা জয়পুরহাট চিনিকল কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁর পাওনা। তিন মাস হয়ে গেলেও ওই টাকা পাননি। টাকা না পাওয়ায় আখ পরিবহনের এবং লেবারের (শ্রমিক) টাকা এখনো পরিশোধ করতে পারেননি। তিনি নিজের ছয় বিঘা জমিতে এবার আখ চাষ করেছিলেন। তাঁর এক মামার সঙ্গে যৌথভাবে ১৬ বিঘা জমিতে আখ লাগান, যা আগামী মৌসুমে চিনিকলে বিক্রি করতেন। কিন্তু চিনিকলে আখ বিক্রি করে টাকা পাওয়ার যে ভোগান্তি, এর চেয়ে আবাদ না করাই ভালো। এ জন্য তিনি এক বিঘা জমিতে আখ রেখে বাকি ১৬ বিঘা জমির আখ উপড়ে ফেলেছেন। সেখানে অন্য ফসলের চাষ করেছেন। তাঁর এলাকায় এ রকম অনেক আখচাষি জমি থেকে আখ উপড়ে ফেলে কলা ও পাট চাষ করেছেন। তিনি আরও বলেন, চিনিকলে টাকা নিতে গেলে কর্তৃপক্ষ শুধু আশ্বাস দেয়, সামনের সপ্তাহে টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু সামনের সপ্তাহ আর আসে না। তাঁদের অপেক্ষার পালা আর ফুরায় না।

জয়পুরহাট সদর উপজেলার গাড়িয়াকান্ত গ্রামের আখচাষি হাফিজার রহমান আখ বিক্রির বাকি আড়াই লাখ টাকা পাবেন। এবার মনের দুঃখে দুই একর জমির আখ উপড়ে ফেলেছেন। ওই জমিতে পাটসহ অন্য ফসলের আবাদ করছেন। তিনি বলেন, কৃষকেরা একটি ফসল বিক্রি করে সেই টাকায় আরেকটি ফসল আবাদ করেন। আখ চাষ করলে আর অন্য ফসল করা ভাগ্যে জুটবে না।

জয়পুরহাট চিনিকলের অধীনে জয়পুরহাট জেলা, নওগাঁ ও দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলায় আখ চাষ হয়ে থাকে। চাষিরা জয়পুরহাট চিনিকলে আখ বিক্রি করেন। ২০১৮-১৯ মৌসুমে চিনিকলের অধীন আখ চাষ হয়েছিল ৫ হাজার ৯০০ একর জমিতে। ২০১৯-২০ মাড়াই মৌসুমের জন্য আখ চাষ হয়েছে ৪ হাজার ৫০০ একর জমিতে। গত বছরের চেয়ে এবার ১ হাজার ৪০০ একর কম জমিতে আখ চাষ হয়েছে। বছর বছর আখের আবাদ কমে যাওয়ায় চিনিকল কর্তৃপক্ষ চিনিকলের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চিনিকলের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা জানতে পেরেছেন, বিভিন্ন এলাকার চাষি জমি থেকে আখ উপড়ে ফেলে সেখানে অন্য ফসলের আবাদ করছেন। উপড়ে ফেলা আখের জমির পরিমাণ ৩০০ থেকে ৩৫০ একর হতে পারে, যা চিনিকলের জন্য দুঃসংবাদ।

চিনিকলের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, আখচাষিদের পাওনা টাকা নির্দিষ্ট সময়ে দিতে না পারায় তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়ে আগামী মাড়াই মৌসুমে বিক্রির জন্য জমিতে লাগানো আখ উপড়ে ফেলে সেই জমিতে অন্য ফসল বুনছেন। এটা চিনিকলের জন্য অশনিসংকেত।

নওগাঁ জেলায় কর্মরত চিনিকলের একজন মাঠ কর্মকর্তা বলেন, চিনিকলের অধীন অনেক চাষি তাঁদের জমির আখ উপড়ে ফেলছেন। তাঁদের ক্ষোভ এতটাই বেশি যে তাঁদের কোনোভাবে নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না। চিনিকল প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে ক্রান্তিকাল যাচ্ছে।

২০১৮-১৯ আখমাড়াই মৌসুমে চিনিকল কর্তৃপক্ষের কাছে চাষিদের পাওনা রয়েছে ১৬ কোটি টাকা। এ মৌসুমে ৩ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন চিনি অবিক্রীত রয়েছে। এর দাম ১৮ কোটি ৯৬ হাজার টাকা। অবিক্রীত রয়েছে ৪ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন চিটাগুড়। আনুমানিক দাম ৪ কোটি টাকা বলে চিনিকল সূত্রে জানা গেছে।

জয়পুরহাট চিনিকল সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ আখমাড়াই মৌসুমে ছয় হাজার চাষির কাছ থেকে আখ কিনে সেই আখ মাড়াই করে ৩ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন করা হয়।

জয়পুরহাট চিনিকলের সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম বলেন, চার মাস ধরে শ্রমিক–কর্মচারীদের বেতন বকেয়া রয়েছে। তাঁরা এখন ধারদেনা করে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। চিনিকলের প্রাণ আখচাষি। তাঁদেরও বিপুল পরিমাণ টাকা পাওনা রয়েছে।

জয়পুরহাট সদর উপজেলার কুজিশহর গ্রামের আখচাষি প্রশান্ত কুমার ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, তিন মাস হলো আখ বিক্রি করা হয়েছে। পাওনা টাকা রয়েছে দেড় লাখ। তিনি আট বিঘা জমিতে আখ চাষ করেছেন। আগামী বছর চার বিঘা জমিতে চাষ করার চিন্তাভাবনা করছেন। এখন বোরো ফসলের আবাদের জন্য টাকার দরকার, হাতে টাকা নেই।

সদর উপজেলার চকশ্যাম গ্রামের কৃষক শিক্ষক রায়হান হোসেন বলেন, তাঁর আখ বিক্রির টাকা পাওনা রয়েছে ৯০ হাজার টাকা। এখনো ওই টাকা পাওয়া যায়নি। কবে পাবেন, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

জয়পুরহাট জেলা আখচাষি কল্যাণ সমিতির আহ্বায়ক কে এম লায়েক আলী বলেন, আখচাষি না থাকলে চিনিকল থাকবে না। আখ বিক্রি করে চাষিরা চিনিকলে ধরনা দিয়েও টাকা পাচ্ছেন না। তিনি দ্রুত আখচাষিদের পাওনা টাকা পরিশোধের দাবি জানান।

জয়পুরহাট চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বলেন, সময়মতো আখচাষিদের পাওনা টাকা পরিশোধ করতে না পারায় তাঁরা আখ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আখ এখন লাভজনক ফসল। কৃষকেরা আবাদ করতে চান। সমস্যা হলো সময়মতো তাঁদের হাতে আখ বিক্রির টাকা না দেওয়া। পাওনা টাকা সময়মতো পরিশোধ করতে পারলে কৃষকেরা আখ চাষে উৎসাহিত হবেন। তিনি আশা করছেন, কৃষকের বকেয়া পাওনা ১৫ এপ্রিলের মধ্যে পরিশোধ করতে পারবেন।