কাজে ফিরলেও পাটকল শ্রমিকদের মনে আতঙ্ক

আন্দোলনের পর আবার কাজে যোগ দিয়েছেন পাটকলের শ্রমিকেরা। গতকাল বিকেলে খুলনার প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিল গেটের সামনে।  ছবি: প্রথম আলো
আন্দোলনের পর আবার কাজে যোগ দিয়েছেন পাটকলের শ্রমিকেরা। গতকাল বিকেলে খুলনার প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিল গেটের সামনে। ছবি: প্রথম আলো

টানা তিন দিনের কর্মবিরতি ও এক দিনের সাপ্তাহিক ছুটি শেষে কাজে ফিরেছেন খুলনার রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের শ্রমিকেরা। গতকাল শনিবার সকাল থেকেই কাজে যোগ দেন তাঁরা। মিলের খটখট শব্দ আর শ্রমিকদের পদচারণে আবারও মুখর হয়ে উঠেছে পাটকলগুলো।

তবে নতুন আতঙ্ক ভর করেছে শ্রমিকদের মনে। গত বৃহস্পতিবার শ্রমিকদের অবরোধ চলাকালে পুলিশের ওপর হামলা ও পুলিশ বক্স ভাঙচুরের ঘটনায় হওয়া মামলাটি তাঁদের আতঙ্কের কারণ। ওই হামলায় পুলিশের চার সদস্য আহত হন, ভাঙচুর করা হয় দৌলতপুরের পাবলা পুলিশ বক্সটি। এ ঘটনায় দৌলতপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) অমিত বাগচী বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ২০০ থেকে ২৫০ জন শ্রমিক নামধারী দুষ্কৃতকারীকে। মামলায় কখন কাকে গ্রেপ্তার করা হবে, এখন সেই আতঙ্কে রয়েছেন শ্রমিকেরা।

বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দাবির ব্যাপারে আলোচনার জন্য শুক্রবার রাতেই শ্রমিকনেতারা চলে যান ঢাকায়। গ্রেপ্তার–আতঙ্কে থাকা শ্রমিকেরা কাজে যোগ দেবেন কি না, তা নিয়ে ছিলেন দ্বিধার মধ্যে। পরে শ্রমিকনেতাদের আশ্বাসের ভিত্তিতে তাঁরা কাজে যোগ দিয়েছেন।

গতকাল মিলগুলোয় ঘুরেফিরে মামলার বিষয়টি উঠে আসে। কয়েকজন শ্রমিক এক জায়গায় হলেই উঠে আসছে মামলার কথা। তবে তাঁদের অভয় দিচ্ছেন শ্রমিকনেতারা। তাঁদের দাবিগুলো নিয়ে বিজেএমসি ও সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। আলোচনায় মামলার কথাও তুলে ধরা হচ্ছে। তাই দাবি পূরণ করা হলে মামলাও থাকবে না, এমনটাই শ্রমিকদের বোঝাচ্ছেন শ্রমিকনেতারা।

বেলা দেড়টার দিকে ক্রিসেন্ট জুট মিলের গেটে গিয়ে দেখা যায়, কিছু শ্রমিক বেলা দুইটার শিফটে কাজে যোগ দেওয়ার জন্য গাছের ছায়ায় বসে আছেন। দুইটায় অন্য শিফটের কাজ শেষ হলে তাঁরা গিয়ে কাজ শুরু করবেন। আলোচনারত শ্রমিকদের কাছে গিয়ে জানা গেল মামলা নিয়ে তাঁদের আতঙ্কের কথা। কেউ কেউ বলছেন, মামলা হওয়ায় সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে রয়েছেন তাঁদের গৃহিণীরা। দুশ্চিন্তায় রাতে তাঁদের ঠিকমতো ঘুমও হয় না। একে তো পেটে খাবার নেই, অন্যদিকে মামলার চিন্তা ঘুরেফিরে আসছে তাঁদের মনে।

ক্রিসেন্ট জুট মিলের গেটের সামনে কয়েকজন পাটকলশ্রমিকের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, আন্দোলন না করলে শ্রমিকদের কোনো দাবিই মানা হয় না। এ কারণে দাবি আদায়ে আন্দোলন করতে হয়, মাঠে থাকতে হয়। কিন্তু ওই আন্দোলনে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় হওয়া মামলা তাঁদের আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে। কারণ, মামলায় কারোর নাম উল্লেখ করা হয়নি। পুলিশ যাঁকে ইচ্ছা তাঁকেই ওই মামলায় গ্রেপ্তার করে হয়রানি করতে পারে। কাজে যোগ দিলেও মাথার মধ্যে এখন গ্রেপ্তারের চিন্তাটিই বারবার ঘুরেফিরে আসছে।

শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ক্রিসেন্ট জুট মিলে ৯ সপ্তাহের মজুরি বকেয়া রয়েছে। খুলনাঞ্চলের অন্য মিলগুলোয় বকেয়া রয়েছে ৭ থেকে ১১ সপ্তাহের। শ্রমিকেরা পেট চালাতে বিভিন্ন এনজিওর কাছ থেকে টাকা ধার করে সংসার চালাচ্ছেন। বিভিন্ন দোকান থেকে মালামাল বাকি নিতে এখন অনেক টাকা বাকি পড়ে গেছে। এ কারণে দোকানিরাও আর মাল বাকি দিতে চাইছেন না। অনেকের ছেলেমেয়ের পড়াশোনা এখন বন্ধের উপক্রম হয়েছে। এসব কারণেই শ্রমিকেরা আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছেন।

বকেয়া মজুরি প্রদান, মজুরি কমিশন গঠনসহ ৯ দফা দাবিতে আন্দোলন করছে বাংলাদেশ পাটকল শ্রমিক লীগ। সারা দেশে একযোগে হওয়া এই আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন খুলনাঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকলের শ্রমিকেরাও।

দাবিগুলো নিয়ে গতকাল বিজেএমসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে শ্রমিকনেতাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিজেএমসি মিলনায়তনে বেলা ১১টায় অনুষ্ঠিত এ বৈঠক কোনো ফলাফল ছাড়াই শেষ হয়। পরে বিকেল পাঁচটা থেকে আবারও বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। সকালে বৈঠকে অংশ নেওয়া খুলনা ক্রিসেন্ট জুট মিলের সিবিএর সাধারণ সম্পাদক সোহরাব হোসেন প্রথম আলোকে জানান, কোনো ফলাফল ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়েছে। বিকেলের দিকে অল্প কয়েকজন শ্রমিকনেতা মিলে বিজেএমসির চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করবেন।

শ্রমিকদের আতঙ্কের ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পাটকল শ্রমিক লীগের খুলনা-যশোর অঞ্চলের আহ্বায়ক মুরাদ হোসেন বলেন, ওই হামলার সঙ্গে কোনো শ্রমিক জড়িত নন। তাই কোনো শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হলে কঠোর আন্দোলন করা হবে। গ্রেপ্তার–আতঙ্কে শ্রমিকেরা কাজে যোগ দিতে চাচ্ছিলেন না বলে জানান তিনি। পরে তাঁদের বুঝিয়ে কাজে পাঠানো হয়েছে।