নারীদের একটি দিন, ওয়াও!

বাংলা একাডেমিতে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা ওয়াও ফাউন্ডেশনের অংশীদারত্বে ‘উইমেন অব দ্য ওয়ার্ল্ড-ওয়াও’ উৎসবে অংশ নেয় শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুরা।  ছবি: প্রথম আলো
বাংলা একাডেমিতে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা ওয়াও ফাউন্ডেশনের অংশীদারত্বে ‘উইমেন অব দ্য ওয়ার্ল্ড-ওয়াও’ উৎসবে অংশ নেয় শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুরা। ছবি: প্রথম আলো

ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী মীম আক্তারের বাবা নেই। মা থাকেন দুবাইয়ে। মোহাম্মদপুরের একটি সেফ হোমে থেকে পড়াশোনা করছে সে। হোমের অন্য মেয়েদের সঙ্গে বাংলা একাডেমিতে এসেছে। ঘুরতে ঘুরতে হুট করে দাঁড়িয়ে এক জায়গায় গেল। আরও নারীদের সঙ্গে মিলে শুরু করল আত্মরক্ষার কৌশল রপ্ত করা।

বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে গতকাল শনিবার শেষ হয়েছে দুই দিনের ওয়াও উৎসব। ছোট-বড় মিলিয়ে গোটা পঞ্চাশেক স্টলে ছিল নানা আয়োজন। এমনি একটি স্টলে নারীদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখানো হয় গতকাল। আর সেখানেই প্রশিক্ষণার্থী বনে গেল মীম। সে জানায়, আত্মরক্ষার কৌশলগুলো শেখার পরে রাস্তায় একা চলার ভয় অনেকটা কেটে গেছে। সব মেয়েরই কৌশল জানা উচিত।

বাংলা একাডেমিতে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা ওয়াও ফাউন্ডেশনের অংশীদারত্বে প্রথমবারের মতো ‘উইমেন অব দ্য ওয়ার্ল্ড-ওয়াও’ উৎসবের আয়োজন করেছে ব্রিটিশ কাউন্সিল। নারীর সম্ভাবনা বাস্তবায়নের পথে প্রতিবন্ধকতাসমূহ খুঁজে বের করতে এবং সমস্যাগুলো নিয়ে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা তৈরিতে ও সমাধান পেতে ২০১০ সালে ওয়াও উৎসব শুরু হয়। উৎসবটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে ২০১৮ সালে ওয়াও ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়।

গতকাল শেষ দিন মেলায় ঘুরে দেখা যায়, কোনো স্টলে বসে নারীরা নিজের জীবনের সংগ্রামের গল্প বলছেন, কোনো স্টলে মিলছে মাদ্রাসার ছাত্রীদের আঁকা চিত্রকর্ম, নানান মুখরোচক খাবার কিংবা গয়না।

একাডেমি প্রাঙ্গণজুড়ে বিভিন্ন বয়সী মানুষের ভিড়। তবে নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দৃষ্টি কাড়ে। তাঁরা বিভিন্ন স্টলে ঘুরছেন, জিনিসপত্র কিনছেন, বিভিন্ন খাবার চেখে দেখছেন, সেমিনারে অংশ নিচ্ছেন। চাকরিজীবী বর্ষা রহমান বলেন, ‘এখানে উৎসবের মধ্য দিয়ে বর্তমানে সমাজে নারীদের অবস্থা, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার প্রতিবন্ধকতা এবং এর উত্তরণের উপায় তুলে আনা হয়েছে। বিষয়টি দারুণ।’ ছেলে, ছেলের বউ আর নাতিকে নিয়ে উত্তরা থেকে উৎসবে এসেছেন শর্মিলী হাসান। অবসরপ্রাপ্ত এই শিক্ষক নাতিকে বাসা থেকে আনা খাবার খাওয়াচ্ছেন। বাকিরা স্টল থেকে খাবার কিনে খাচ্ছে। শর্মিলী বলেন, নারীরা এখন আগের তুলনায় সাহসী, দায়িত্বশীল, আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু সমাজে সমস্যাগুলো এখনো রয়ে গেছে।

ঘুরতে ঘুরতেই একাডেমির বর্ধমান হাউসের কাছে চোখ আটকে যায়। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জয়দেব রোয়াজা সেখানে কলার মোচা, কচু, বেগুনসহ নানান পদ রান্না করছেন। উৎসবে আগত দর্শনার্থীরা বিনা মূল্যে সেসব খাবার চেখে দেখছেন।

জয়দেব বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে বাসায় শুধু মাকে রান্না করতে দেখেছি। ফলে আমার ধারণা ছিল, রান্নাটা মেয়েদের কাজ। বড় হয়ে নিজের ভুল বুঝতে পেরে বাসায় রান্নার কাজটি আমিই করি। রান্না নারীদের কাজ নয়, যে কেউ করতে পারে—এই বার্তা দেওয়ার জন্যই রান্নার আয়োজন।’

উৎসবের ২০টি বিষয়ের ওপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা, গল্প বলাসহ নারী দলের বিভিন্ন পরিবেশনা অনুষ্ঠিত হয়। বিকেলে ‘ভালো মেয়ের সংজ্ঞা’ শিরোনামে প্যানেল আলোচনা হয়। সেখানে উঠে আসে বিভিন্ন প্রশ্ন—সমাজে ভালো মেয়ে কে? নারী কি নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্যায়ন করতে পারবে না? ভালো মেয়ের সংজ্ঞা কী যুগ যুগ ধরে একইভাবে চলতে থাকবে? সংজ্ঞা কি শ্রেণিভেদে বদলে যায়?

আলোচক ও নৃত্যশিল্পী পূজা সেনগুপ্ত বলেন, ‘স্কলারশিপ পেয়ে জার্মানিতে পিএইচডি করতে না গিয়ে যখন নৃত্যকলা নিয়ে স্নাতকোত্তর করতে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই, তখন পরিবার থেকে শুরু করে কেউ সেই সিদ্ধান্ত সমর্থন করেনি। ছোটবেলা থেকে পাওয়া ভালো মেয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়ে যায়। নারীকে নিজেকে ভালো মেয়ে বা নারী হওয়ার প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। নিজের জন্য কাজ করতে হবে।’

ওয়াও ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা জুড কেলি বলেন, একজন নারী কী রকম আচরণ করবে, সেটা সমাজ থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এ কারণে নারী যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে হীনম্মন্যতায় ভোগে, অপরাধবোধে ভোগে। পুরুষদের এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় না। এ জন্য নারীকে কখনো একা এবং কখনো সম্মিলিতভাবে এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে কাজ করতে হবে।

অনুষ্ঠানে বাকি দুই আলোচক ছিলেন নেপালের সংগীতশিল্পী সারিনা রাই, বাংলাদেশের সাংবাদিক সুপ্রভা তাসকিন। দুই দিনের উৎসবে বাংলাদেশ ছাড়াও যুক্তরাজ্য, নেপাল ও ভারতের অনেক প্রতিনিধি অংশ নেন। এর পাশাপাশি দেশীয় ১০টি বেসরকারি সংস্থাও অংশ নিয়েছে। মেলায় তাদের স্টলও ছিল। জানা গেছে, নারীদের এই প্ল্যাটফর্মকে শক্তিশালী করতে দেশের কয়েকটি বিভাগীয় শহরে পর্যায়ক্রমে ওয়াও চ্যাপটার নামে একটি অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে।