শেষ হলো মণিপুরি নববর্ষ উৎসব চৈরাউবা

মণিপুরি নববর্ষ উৎসব চৈরাউবা উপলক্ষে ‘থাবল চোংবা’য় নৃত্য পরিবেশন করছেন তরুণ-তরুণীরা। গত শনিবার রাতে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মণিপুরি কালচারাল কমপ্লেক্স চত্বরে। প্রথম আলো
মণিপুরি নববর্ষ উৎসব চৈরাউবা উপলক্ষে ‘থাবল চোংবা’য় নৃত্য পরিবেশন করছেন তরুণ-তরুণীরা। গত শনিবার রাতে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মণিপুরি কালচারাল কমপ্লেক্স চত্বরে। প্রথম আলো

রাত যত বাড়ছিল, বাড়ছিল মণিপুরিদের বর্ণাঢ্য লোকনৃত্যের পরিবেশনা ‘থাবল চোংবা’য় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা। সেই সঙ্গে দর্শকও। মণিপুরি অধ্যুষিত গ্রামগুলো থেকে দলবেঁধে আসছিলেন বাসিন্দারা। ছিলেন অন্য সমাজের মানুষও। একটি নির্দিষ্ট সুর ও তালের গানের সঙ্গে মণিপুরি তরুণ-তরুণীরা গোলবৃত্তে হাতে হাত ধরে নাচছিলেন ‘থাবল চোংবা’ নাচ। এ নৃত্য ছিল দিনব্যাপী মণিপুরি নববর্ষ উৎসব চৈরাউবার শেষ আয়োজন।

গত শনিবার মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের মণিপুরি কালচারাল কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে এ উৎসবের আয়োজন করে মণিপুরি চৈরাউবা পর্ষদ। সকাল থেকেই ছিল নানা আয়োজন। সকালে বের করা হয় আনন্দ শোভাযাত্রা। এতে মণিপুরি ঐতিহ্যবাহী পোশাকে নারী-পুরুষ শোভাযাত্রায় অংশ নেন। শোভাযাত্রাটি মণিপুরি কালচারাল কমপ্লেক্স থেকে বের হয়ে আদমপুর বাজার ঘুরে আবার কমপ্লেক্সে ফিরে আসে। এরপর ছিল মণিপুরি নারীদের অংশগ্রহণে লিকোন শান্নবা বা কড়িখেলা। মঞ্চে নানা বয়সের মণিপুরী নারীরা কড়ি নিয়ে বসেন। উচ্ছ্বাস, চিৎকার, হাসি-হুল্লোড়ের মধ্য দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে খেলা চলে। এর এক ফাঁকে সেরে নেওয়া হলো বন দেবতার পূজাও।

আয়োজকেরা জানান, পৃথিবীর নানা প্রান্তে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে নানা ধরনের বর্ষ গণনার রীতি আছে। মৈতৈ মণিপুরিদেরও ‘মলিয়াফম পালচা কুম’ বা সংক্ষেপে ‘মলিয়াকুম’ নামে পরিচিত একটি বর্ষগণনা রীতি আছে। মণিপুরি ভাষায় ‘কুম’ অর্থ বর্ষ বা সন। এটা প্রচলন করেন মণিপুরের রাজা কাংবার জ্যেষ্ঠ পুত্র ‘কোইকোই’। এই বর্ষ গণনারীতি চান্দ্র পদ্ধতি অনুসরণে। মণিপুরি সমাজেও পয়লা বৈশাখ নববর্ষ হিসেবে প্রচলিত। পাশাপাশি মলিয়াকুমের প্রথম দিনও নববর্ষ হিসেবে উদ্‌যাপিত হয়ে আসছে নীরবে। মণিপুরি ভাষায় নববর্ষকে বলা হয় ‘অনৌবাকুম’। তবে নববর্ষের উৎসবকে বলা হয় ‘শজিবু চৈরাউবা’ বা শুধুই ‘চৈরাউবা’।

সন্ধ্যার পর অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা। এতে সভাপতিত্ব করেন চৈরাউবা পর্ষদের সভাপতি কবি ও মণিপুরি গবেষক এ কে শেরাম। পর্ষদের সম্পাদক কবি সনাতন হামোমের সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি ছিলেন মুসলিম মণিপুরি সমাজের নেত্রী এবং কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদের নবনির্বাচিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান বিলকিস বেগম। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন লেখক চৌধুরী বাবুল বড়ুয়া, তেতইগাঁও উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল মতিন, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সালেহ এলাহী প্রমুখ।

বক্তারা বলেন, নানা জাতি-ধর্মের মানুষের বাস এই জনপদে। যুগ যুগ ধরে নিজের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি লালন করে সবাই মিলে জীবন যাপন করছে। ধর্ম যার যার হলেও এখানে উৎসব সবার। সবাই মিলে এই বৈচিত্র্যের ভূমির মানুষ উৎসব–পার্বণে দিন যাপন করে। এই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যই মানুষে মানুষে মেলবন্ধন ঘটিয়ে চলছে। এরপরই শুরু হয় নির্দিষ্ট স্থানে থাবল চোংবা। অনেক রাত পর্যন্ত এই নৃত্যগীত চলে।