কচুরিপানায় মরতে বসেছে চিত্রা

কচুরিপানার জটে আটকা নড়াইলের চিত্রা নদী। সম্প্রতি জেলা প্রশাসকের বাসভবনের সামনে। প্রথম আলো
কচুরিপানার জটে আটকা নড়াইলের চিত্রা নদী। সম্প্রতি জেলা প্রশাসকের বাসভবনের সামনে। প্রথম আলো

চিত্রা নদীর নড়াইলের অংশ দীর্ঘদিন ধরে কচুরিপানায় ভরে আছে। প্রায় দুই দশক এ নদীতে নৌযান চলাচল বন্ধ। কচুরিপানার জঞ্জালে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে মরে যাচ্ছে নদীটি। হুমকিতে পড়েছে জলজ জীববৈচিত্র্য। মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ায় জেলেদের জীবন-জীবিকাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

এলাকাবাসী বলছেন, স্রোত কমে যাওয়ায় নদীটির বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে নাব্যতা-সংকট। জেগেছে ছোট-বড় চর। এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে নদীটি মরা খালে পরিণত হবে বলে তাঁদের শঙ্কা।

পাউবোরও ভাষ্য, কচুরিপানার জটে নদীতে পানির স্রোত কমে গেছে। এতে কমলাপুর ও গর্ন্ধব্যখালী এলাকার দুটি পাম্প হাউস থেকে পানি নিষ্কাশনও বন্ধ হয়ে গেছে। বেড়িবাঁধের ভেতরেও কচুরিপানায় ভরে আছে। পাম্প হাউস দুটি বিকল থাকায় কৃষিজমিতে সেচকাজ ব্যাহত হচ্ছে।

উপজেলা ভূমি কার্যালয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নড়াইলে চিত্রা নদীর দূরত্ব ১৭০ কিলোমিটার। সদর উপজেলার রতডাঙ্গা ত্রিমোহনী থেকে কালিয়া উপজেলার পেড়লী বাজার ত্রিমোহনী গিয়ে নবগঙ্গা নদীর সঙ্গে মিশেছে।

গত বুধবার নদীটির রতডাঙ্গা, শেখ রাসেল সেতু, আউড়িয়ায় এস এম সুলতান সেতু, গোবরাবাজার, শিঙ্গাশোলপুর বাজার, চুনখোলা সেতুর অংশ ঘুরে দেখা গেছে, নদীতে ঘন কচুরিপানা। সেখানে পানি আছে কি না, তা-ও বোঝা যাচ্ছে না। কোনো নৌযান চোখে পড়েনি। অনেক বস্তু নদীর কিছু এলাকায় কচুরিপানায় আটকা পড়ে পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। পাড়ে দাঁড়ানো কঠিন। মশা-মাছি ভনভন করছে। নদীটির পেড়লী এলাকায় মাত্র তিন-চার কিলোমিটারজুড়ে কচুরিপানা নেই। বাকি প্রায় সব অংশ কচুরিপানায় ভর্তি।

কমলাপুর গ্রামের প্রবীণ কৃষক নিরাপদ বিশ্বাস, ইউনুস শেখ, গোলাম মোস্তফা বলেন, একসময় এ নদীতে অনেক স্রোত ছিল। স্টিমার, লঞ্চ, কার্গো, নৌকা, ট্রলারসহ বিভিন্ন নৌযান চলাচল করত। লোকজন এখান দিয়ে লঞ্চে উত্তরে মাগুরা, দক্ষিণে খুলনা, বড়দিয়া, গোপালগঞ্জ, বরিশাল ও ঢাকায় যাতায়াত করত। ফসল ও মালামাল আনা-নেওয়া করা হতো। সেসব কথা আজ রূপকথার মতো শোনায়।

নদীতীরবর্তী পূর্ব সীমাখালী গ্রামের বাসিন্দা কাকলি বিশ্বাস বলেন, এলাকার প্রতিটি পরিবারের স্নান, থালাবাসন ধোয়াসহ সব কাজই করতে হয় নদীতে। কচুরিপানা ভরে থাকায় কিছুই করা যাচ্ছে না।

নদীর এই পরিণতি সম্পর্কে গোবরা এলাকার স্কুলশিক্ষক ইদ্রিস আলী বলেন, ১৯৮৬ সালে মাগুরা শহরে নদীর ওপর তৎকালীন পানিসম্পদমন্ত্রী (এম মাজেদুল হক) স্লুইসগেট নির্মাণ করার পর থেকে নদীর নাব্যতা কমতে থাকে। এ ছাড়া নদীর ওপর ঘন ঘন সেতু নির্মাণ করার কারণেও পলি জমে নাব্যতা কমেছে। তিনি বলেন, কুষ্টিয়ার গড়াই নদ ও খুলনার আত্রাই নদীর সঙ্গে এই নদীর সংযোগ ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে নদীতে নৌকা চলাচল করলেও আশির দশক থেকে নদীতে নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এখন নদীতে স্রোত কমে গেছে। বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে নাব্যতা-সংকট। জেগে উঠেছে অসংখ্য ছোট-বড় চর। এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে নদীটি মরা খালে পরিণত হবে।

শহরের রূপগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী সুকুমার কুন্ডু বলেন, নদীতে যখন নৌকা অথবা লঞ্চ চলেছে, তখন কম খরচে সব ব্যবসায়ী লঞ্চে করে খুলনা থেকে মালামাল আনা-নেওয়া করতেন। এখন কচুরিপানা ও নাব্যতা-সংকটের কারণে সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।

যোগাযোগ করলে পাউবোর নড়াইল কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, চিত্রা, ভৈরব, আফরা নদ-নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে নদী খননসহ দুটি পাম্প হাউস নির্মাণ করতে মন্ত্রণালয়ে ১ হাজার ৮৩৫ কোটি ৩১ লাখ টাকার প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। টাকা পেলে নদী খননের কাজ শুরু করা হবে।