বৈশাখ ঘিরে ব্যস্ত বাঁশির গ্রাম

.
.
যেভাবে তৈরি হয় বাঁশি
* প্রথমে বাঁশ কেটে মাপমতো টুকরো করা হয়
* তপ্ত লোহা দিয়ে সেই বাঁশ ছিদ্র করা হয়
* ছিদ্র করা বাঁশে তোলা হয় নকশা
* সেই নকশা করা বাঁশে করা হয় রং
* দুই ধরনের বাঁশ থেকে বাঁশি তৈরি করা হয়—বড় আকারের বাম্বুবাঁশ ও ছোট আকারের মুলিবাঁশ
* সাধারণত পাঁচ ধরনের বাঁশি হয়। এগুলো হলো মুখ, আড়, নাগিন, ক্ল্যাসিক ও মোহন বাঁশি

বাঁশ কেটে মাপমতো টুকরো করছেন কেউ। আগুনে তপ্ত লোহার শিক দিয়ে সেই বাঁশ ছিদ্র করা হচ্ছে। কেউ ছিদ্র করা বাঁশে ডোরাকাটা নকশা তুলছেন। সেই বাঁশে রং করছেন আর কেউ। এভাবে যে বাদ্যযন্ত্রটি তৈরি হচ্ছে, সেটি গ্রামবাংলার অন্যতম ঐতিহ্য—বাঁশি।

বাঁশি তৈরির এই কর্মযজ্ঞ চলছে কুমিল্লার হোমনা উপজেলার তিতাস নদের পশ্চিম পারে, শ্রীমর্দ্দি গ্রামে। সবুজে ঘেরা এ গ্রামের লোকজন প্রায় শতবর্ষ ধরে বাঁশ দিয়ে এ বাদ্যযন্ত্র তৈরি করে আসছেন। এটি পরিচিতি পেয়েছে বাঁশির গ্রাম নামে। এখানকার বাঁশির মোহন সুর ছড়িয়ে পড়ছে জেলা ছাড়িয়ে দেশের নানা প্রান্তে।

জানতে চাইলে হোমনা পৌরসভার মেয়র নজরুল ইসলাম বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকে শ্রীমর্দ্দি গ্রামে বাঁশি তৈরি করা হয়। এখানকার বাঁশি ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে যায়। প্রায় দুই শ পরিবার এ কাজের সঙ্গে জড়িত। এসব পরিবারের আড়াই-তিন হাজার লোক বাঁশি তৈরি করেন।

গ্রামটির লোকজন বলেন, সারা বছরই এ গ্রামের নারী, পুরুষ ও শিশু-কিশোরেরা বাঁশি তৈরি করেন। তবে পয়লা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ ঘিরে ব্যস্ততা বাড়ে। বৈশাখী মেলায় এখানকার বাঁশির চাহিদা থাকে অনেক বেশি। বিকিকিনিও হয় দেদার। তাই চৈত্র থেকেই ভোরের আলো ফুটতে না–ফুটতে বাঁশি তৈরির কাজে লেগে যান সবাই।

বাঁশির কারিগর শিল্পী রানী সরকার বলেন, ‘আমি কয়েক বছর ধরে বাঁশি তৈরি করছি। অন্যের কাজ করে দিই। বৈশাখ উপলক্ষে কাজ এখন বেশি। পারিশ্রমিকও একটু বেশি।’

সম্প্রতি গ্রামটিতে গিয়ে দেখা যায়, মোড়া পেতে বাঁশি তৈরি করছেন নানা বয়সী মানুষ। বাঁশ কেটে মাপমতো টুকরো করছেন কেউ। আগুনে তপ্ত লোহার শিক দিয়ে সেই বাঁশ ছিদ্র করা হচ্ছে। কেউ ছিদ্র করা বাঁশে ডোরাকাটা নকশা তুলছেন। সেই বাঁশে করা হচ্ছে রং।

সিরাজুল ইসলামের বয়স ৬৫ ছুঁই–ছুঁই। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বাঁশি তৈরির কাজে বাবাকে সাহায্য করা শুরু করেন। বাবার মৃত্যুর পর নিজেও এ কাজে জড়িয়ে পড়েন। প্রতিবছর কয়েক হাজার বাঁশি তৈরি করেন তিনি। এ কাজে স্ত্রীও তাঁকে সহযোগিতা করেন।

সিরাজুল ইসলাম বলেন, একসময় এ গ্রামের টেকপাড়ার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বাঁশি তৈরি করে বিক্রি করতেন। তখন এলাকায় ১২০ থেকে ১২৫ জন কারিগর ছিলেন। এখন কারিগর কমে গেছে। ৩০ জনের মতো রয়েছেন।

একই গ্রামের নন্দলাল মজুমদার বলেন, ‘পাকিস্তান আমল থেকে আমরা বাঁশি তৈরি করছি। গ্রামের হিন্দু পরিবারের পাশাপাশি সাতটি মুসলমান পরিবার এ কাজে জড়িত। হাতের কাজ করা বাঁশির মান ভালো হয়। এর চাহিদা বেশি, দামও বেশি। রঙের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাঁশির দামও বেড়েছে।’

মজুমদার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, হরিলাল মজুমদার ও সুস্মিতা রানী মজুমদার দম্পতি কয়লার মধ্যে লোহা গরম করে বাঁশে ছিদ্র করছেন। হরিলাল বলেন, ৪০ বছর ধরে তিনি এ কাজ করছেন। বিয়ের পর স্ত্রী তাঁকে সার্বক্ষণিক এ কাজে সহযোগিতা করছেন। বংশপরম্পরায় তাঁরা এ পেশায় আছেন।

এ গ্রামের অনিল বিশ্বাস, গোপাল বিশ্বাস, প্রমিলা বিশ্বাস, রতন বিশ্বাস, যতীন্দ্র বিশ্বাস ও চিত্তরঞ্জন বিশ্বাসের পরিবার শতবর্ষ থেকে বাঁশি তৈরি করছেন। তাঁরা বলেন, বাঁশি বিক্রি করেই জীবন–জীবিকা নির্বাহ করছেন তাঁরা। ঘুরছে সংসারের চাকা।

কারিগরেরা জানান, দুই ধরনের বাঁশ থেকে বাঁশি তৈরি করা হয়। বড় আকারের ১৬টি বাম্বু বাঁশের এক আঁটির দাম সাত হাজার টাকা। আর ছোট আকারের ৮০টি মুলিবাঁশের দাম ৪০০ টাকা। খাগড়াছড়ির রামগড় ও চট্টগ্রামের বড় দারোগার হাট থেকে এসব বাঁশ আনা হয়। বড় আকারের একটি বাঁশ থেকে আটটি এবং ছোট আকারের বাঁশ থেকে পাঁচটি করে বাঁশি তৈরি করা যায়। সাধারণত পাঁচ ধরনের বাঁশি তৈরি করা হয়। এগুলো হলো মুখ, আড়, নাগিন, ক্ল্যাসিক ও মোহন বাঁশি। ধরন ও আকারভেদে বাঁশির দাম আলাদা। শিশুদের জন্য তৈরি মুখ বাঁশির দাম সর্বনিম্ন ২ টাকা থেকে ১০ টাকা। ক্ল্যাসিক বাঁশির দাম ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকা। মোহন বাঁশি ১০ টাকা, আড় বাঁশি ১০ টাকা, মুখ বাঁশি ২ থেকে ৫ টাকা এবং নাগিন বাঁশি ৫০ টাকা। ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে পাইকারি ক্রেতারা এসে বাড়ি থেকে বাঁশি কিনে নেন। কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, চাঁদপুর ও ফেনী থেকেও ক্রেতারা এসে এখান থেকে পাইকারি দরে বাঁশি কিনে নেন।

কুমিল্লার অধুনা নাট্যসংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শহীদুল হক বলেন, শ্রীমর্দ্দি গ্রামে একসময় প্রচুর কারিগর ছিলেন। এখন অনেকেই নানা পেশায় ঝুঁকছেন। তবু ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন তাঁরা। শ্রীমর্দ্দি গ্রাম বিভিন্ন অঞ্চলের বাঁশির চাহিদা মেটায়। এখানকার মোহন বাঁশির সুর শোনা যায় অন্য অঞ্চলেও।