গানের তালে জঞ্জাল সাফ

গানে গানে চলছে শিশু-কিশোরদের নগর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সচেতন করার ভিন্নধর্মী উদ্যোগ। গত রোববার দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের পাথরঘাটা সিটি করপোরেশন বালক উচ্চবিদ্যালয়ে।  ছবি: সৌরভ দাশ
গানে গানে চলছে শিশু-কিশোরদের নগর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সচেতন করার ভিন্নধর্মী উদ্যোগ। গত রোববার দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের পাথরঘাটা সিটি করপোরেশন বালক উচ্চবিদ্যালয়ে। ছবি: সৌরভ দাশ

ক্লাস শেষের ঘণ্টা পড়ল সবে। হঠাৎ ভেসে আসল মাইকের আওয়াজ। গিটার হাতে সাত তরুণ-তরুণী গান ধরেছেন—‘পলিথিনে নালা জমে, দেশ আটকে যাচ্ছে ক্রমে। একটু সচেতন হলে আটকাবে না দেশটা জলে...।’ মুহূর্তেই কয়েক শ শিক্ষার্থী এসে ভিড় করে তাঁদের চারপাশে। খালি গলায় সেই গানে তাল মেলাতে মেলাতে শিক্ষার্থীর দল নেমে পড়ে আবর্জনা পরিষ্কারে। ধীরে ধীরে স্কুল প্রাঙ্গণ হয়ে উঠে ঝকঝকে-তকতকে।

গানে গানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সচেতন করে তোলার এই চিত্র চট্টগ্রাম নগরের পাথরঘাটা সিটি করপোরেশন বালক উচ্চবিদ্যালয়ের। নগরকে জলাবদ্ধতা মুক্ত করতে ভিন্নধর্মী এই কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে একদল তরুণ। তাঁরা পথেঘাটে ময়লা না ফেলা এবং আবর্জনা অপসারণের জন্য গানে গানে শিশু-কিশোরদের সচেতন করেন। পাশাপাশি শিখিয়ে দেন ফেলনা বর্জ্য ব্যবহার উপযোগী করে তোলার কৌশলও।

যেখান থেকে এ উদ্যোগ

এ উদ্যোগের পেছনে আছেন অভি কিম্বেল ও লুসি তৃপ্তি গমেজ নামের দুই তরুণ-তরুণী। অনেক দিন ধরে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত এ দুজনের বাস ছিল ঢাকায়। তবে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে স্থায়ীভাবে তাঁরা চট্টগ্রামে চলে আসেন। সে সময়ে প্রতি বর্ষায় ডুবে যাওয়া চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রকল্প নিয়ে বেশ তোড়জোড় চলছিল। তাঁরা ভাবতে থাকেন শুধু প্রকল্প নয় মানুষের সচেতনতাও পারে জলাবদ্ধতা নিরসনে ভূমিকা রাখতে। সেই থেকে ২০১৮ সালের পয়লা বৈশাখে তাঁরা মানুষকে সচেতন করতে যান সিআরবি এলাকায়। জনে জনে বোঝান নির্ধারিত জায়গায় ময়লা ফেলার প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু সাড়া পাননি। বুঝে যান এভাবে হবে না। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেরমিশেল ঘটাতে হবে। এ ভাবনা থেকেই কিম্বেল লিখে ফেলেন ‘বর্জ্য ব্যবহার্য হলে, পরিষ্কারের শিক্ষা পেলে। মিলবে সোনার দেশ, এই বাংলাদেশ’—শিরোনামে ১০ লাইনের একটি গান। এরপর একই বছরের ১৫ মে সতীশ বাবু লেনে গানটি গেয়ে গেয়ে সচেতনতা ও সড়ক পরিষ্কারের জন্য মাঠে নামেন তাঁরা। বেশ সাড়া মেলে তাতে। এর মধ্যেই তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন রনি আনসারী, বিরাজ সরকার, প্রিজন দাস, শেইন গানজালবেস, রাসু দাস, জন প্রিমো ও মহিউদ্দিন নামের আরও সাত তরুণ। খোলেন ‘স্লোগান বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন।

যত কার্যক্রম

এ পর্যন্ত তিনটি বিদ্যালয়ে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন তাঁরা। এই কার্যক্রমে পাথরঘাটা ওয়ার্ডের সব পথে ঘোরা হয়ে গেছে তাঁদের। সবখানেই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো শিশু-কিশোরের দল পিছু নিয়েছে তাঁদের। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ের সেই গানটি বর্তমানে পাথরঘাটার শিশু-কিশোরদের মুখে মুখে।

রোববার দুপুরে পাথরঘাটা সিটি করপোরেশন বালক উচ্চবিদ্যালয়ে দেখা যায়, স্লোগান বাংলাদেশের সদস্য ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গান গাইছেন পাথরঘাটা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইসমাইল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্লোগানের কার্যক্রমকে শুরু থেকেই সমর্থন দিয়ে আসছি। তাঁদের ভিন্নধর্মী উদ্যোগে পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠছে পাথরঘাটা ওয়ার্ড।’

গানে গানে সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি স্লোগানের সদস্যরা শিক্ষার্থীদের ফেলনা বর্জ্য কাজে লাগানোর প্রক্রিয়া নিয়ে ধারণা দিচ্ছিলেন। অনেকগুলো খালি বোতল পলিথিন দিয়ে ভরাট করে তা দিয়ে কীভাবে মোড়া বানানো যায় তা দেখে শিক্ষার্থীরা উচ্ছ্বসিত হোন। স্কুলের আঙিনা পরিচ্ছন্ন করতে করতে বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির দুই শিক্ষার্থী শান্ত দাশ ও সাব্বির হোসেন প্রথম আলোকে বলে, গানটির কথাগুলো তাদের মুখস্থ। তারা এখন যেখানে–সেখানে ময়লা ফেলে না। অন্যদেরও না ফেলতে অনুরোধ করে।

এই তরুণদের উদ্যোগের ফলে এলাকাবাসীর মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে তার কিছুটা প্রমাণ মেলে পাথরঘাটার পথ ঘুরে। মানুষজন নির্ধারিত জায়গাতেই রাখছেন ময়লা-আবর্জনা। তাই নালা-নর্দমা বেশ পরিচ্ছন্ন দেখা যায়।

ভিন্নধর্মী এ উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অভি কিম্বেল ও লুসি তৃপ্তি গমেজ বলেন, শুধু পথঘাটের বর্জ্য না। তাঁরা এই কর্মসূচির মাধ্যমে দূর করতে চান মাদক, ইভ টিজিংয়ের মতো ‘সামাজিক বর্জ্যও’। কারণ তাঁরা মনে করেন—শিশুরা শুরুতেই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেদের সম্পৃক্ত করলে এসব থেকে দূরে থাকবে।