ফরিদপুরে বন্দরে আসার পথে নৌযানে চাঁদাবাজি

ফরিদপুর সিঅ্যান্ডবি ঘাট নৌবন্দর। ছবি: প্রথম আলো
ফরিদপুর সিঅ্যান্ডবি ঘাট নৌবন্দর। ছবি: প্রথম আলো

ফরিদপুর সিঅ্যান্ডবি ঘাট নৌবন্দরে পণ্য আনার পথে দুই জায়গায় চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এ ব্যাপারে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে স্মারকলিপি দিয়েও মেলেনি কোনো প্রতিকার।

সিঅ্যান্ডবি ঘাট নৌবন্দরে আসার পথে মুন্সিগঞ্জের বাদিয়ারটেক এলাকা এবং শরীয়তপুরের কলিকাল এলাকায় চাঁদাবাজদের খপ্পরে পড়তে হয় সিমেন্ট, লোহা, কয়লা, বালু, পাথর ব্যবসায়ীদের। ওই এলাকায় এলেই ছোট নৌকায় করে চাঁদাবাজেরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ট্রলারে হামলা করে। প্রতিটি ট্রলার থেকে দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করে। চাঁদা না পেলে ট্রলারের চালক ও শ্রমিকদের মারধর করা হয়।
ফরিদপুর নৌবন্দর থেকে ওই পথে প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ৬০টি ট্রলার, কার্গো আসা-যাওয়া করে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পণ্যবাহী ট্রলার মালিক সমিতি ফরিদপুর শাখা এবং বাংলাদেশ কার্গো ট্রলার বাল্কহেড শ্রমিক ইউনিয়ন ফরিদপুর জেলার শাখার পক্ষ থেকে নৌ পুলিশের ডিআইজি, মুন্সিগঞ্জের পুলিশ সুপার, লোহজং, জাজিরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে লিখিত আবেদন দেওয়া হয়েছে।
গত ৭ মার্চ দেওয়া ওই আবেদনে বলা হয়, পুরোনো মাওয়া ঘাট থেকে দেড় কিলোমিটার ভাটিতে বাদিয়ারটেক এলাকা ও বাদিয়ারটেক থেকে আনুমানিক আড়াই কিলোমিটার ভাটিতে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার কলিকাল এলাকায় এই পথে চলাচলকারী সব নৌযান থেকে চাঁদা নিচ্ছে সংঘবদ্ধ কয়েক দল চাঁদাবাজ। চাহিদামতো অর্থ না দিলে লোকজনকে পিটিয়ে কুপিয়ে আহত করে। ভয়ে মাঝিরা নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, মুন্সিগঞ্জ থেকে ফরিদপুরে পণ্য নিয়ে আসতে চায় না। এতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। অন্যদিকে সরকারও রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
লিখিত অভিযোগে এ চাঁদাবাজির ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের কয়েকজনের নাম দেওয়া হয়েছে। এরা মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার গাঁওদিয়া ইউনিয়নের সমুরবাড়ির গ্রামের বাসিন্দা। লিখিত অভিযোগে যাঁদের নাম দেওয়া হয়েছে, তাঁরা হলেন মো. রুবেল মাতবর, মো. শাহাবুদ্দিন, মো. আল-আমিন, মো. মাসুম ও মো. আনোয়ার।
অভিযোগ নিয়ে মো. রুবেল মাতবরের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। প্রথমে নিজের পরিচয় স্বীকার করলেও চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলতেই ‘এটা রুবেলের নম্বর না’ বলে কেটে দেন তিনি। পরে ওই মুঠোফোনের নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
গাঁওদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের এক ইউপি সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যাঁরা এ চাঁদাবাজি করছেন, তাঁরা আগে বাংলাদেশ পণ্যবাহী ট্রলার মালিক সমিতি ফরিদপুর শাখা এবং বাংলাদেশ কার্গো ট্রলার বাল্কহেড শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্যদের সহায়তায় নদীর পথ চিনিয়ে দেওয়ার কাজ করতেন। বিনিময়ে তাঁরা তেল ও টাকা পেতেন। তবে তাঁরা এ কাজে অসাধুতা ও অবহেলার পরিচয় দেওয়ায় ওই দুই সমিতি সিদ্ধান্ত নিয়ে তিন মাস আগে তাঁদের ওই কাজ থেকে বাদ দিয়েছে। এরপর থেকে এ–জাতীয় চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে।

চাঁদাবাজদের পিটুনিতে আহত সেলিম মাঝি বলেন, ‘আমাদের মারপিট করে সবকিছু নিয়ে যায়। হাত–পা বেঁধে রাখে। মালিকপক্ষ টাকা দিলে তারপরে মুক্তি মেলে।’
সিঅ্যান্ডবি ঘাট এলাকার ব্যবসায়ী মো. মনোয়ার ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ওদের চাঁদা না দিলে ঘাটে নৌকা আসে না। তা ছাড়া এ বিষয়ে অভিযোগ করলে আমাদের আরও ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়।
কার্গো ট্রলার বাল্কহেড শ্রমিক ইউনিয়ন ফরিদপুরের সাধারণ সম্পাদক মো. আতিয়ার রহমান বলেন, ‘পুলিশের কাছে বারবার অভিযোগ করেও সুফল আসছে না। আমরা অবিলম্বে এই চাঁদাবাজ জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্তি চাই।’
সিঅ্যান্ডবি নৌবন্দরের ব্যবসায়ী ও পণ্যবাহী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল শেখ বলেন, ‘প্রতিনিয়ত আমাদের পণ্যবাহী ট্রলার, কার্গো, বাল্কহেড চাঁদাবাজদের খপ্পরে পড়ছে। এতে আমাদের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে এই রুটে পণ্যবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে যবে। এর ফলে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাজস্ব থেকে।’

এ বিষয়ে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনির হোসেন বলেন, ‘অভিযোগের পর আমরা অভিযান অব্যাহত রেখেছি। চাঁদাবাজদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। আমরা এ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড দমনের চেষ্টা করছি।’
এ বিষয়ে শরীয়তপুরের জাজিরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, জাজিরা উপজেলার কলিকাল নৌপথে চাঁদাবাজির ঘটনা যে ঘটে, তা আমাদের জানা। এর আগে এ বিষয়ে একটি মামলাও নেওয়া হয়েছে। তবে নৌরুটটি আমাদের নজরদারি করা হয়ে ওঠে না। এ বিষয়টি নৌ পুলিশরাই দেখে থাকে।
এ ব্যাপারে মাওয়া নৌ পুলিশের দায়িত্বরত কর্মকর্তা মো. আরমান হোসেন বলেন, ‘যে জায়গায় চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটে, সেটি নদীর অনেক গভীরে। আমাদের সক্ষমতার অভাব আছে। এরপরও আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান করছি এবং চাঁদাবাজদের গ্রেপ্তার করাসহ তাদের এ কাজ থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছি।’