শখের মাল্টায় সুখের জীবন শাখাওয়াতের

তীর-প্রথম আলো কৃষি পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষক শাখাওয়াত হোসেন। চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার হোগলডাঙ্গায় নিজের মাল্টা বাগানের যত্ন করছেন তিনি। ছবি: প্রথম আলো
তীর-প্রথম আলো কৃষি পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষক শাখাওয়াত হোসেন। চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার হোগলডাঙ্গায় নিজের মাল্টা বাগানের যত্ন করছেন তিনি। ছবি: প্রথম আলো

শাখাওয়াত হোসেন বাবুল (৫০) শখের বশে খুলনার একটি সরকারি উদ্যান থেকে ২০টি মাল্টার চারা কিনেছিলেন। সেই চারা বদলে দিয়েছে তাঁর জীবন, এনেছে সুখের বারতা। নিজ হাতে কলম তৈরি করে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার হোগলডাঙ্গায় ৪০ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন চার হাজার মাল্টাগাছের বিশাল বাগান। কৃষি উৎপাদনে সাফল্যের জন্য শাখাওয়াত হোসেন সেরা উদ্যান চাষি ক্যাটাগরিতে তীর-প্রথম আলো কৃষি পুরস্কার ২০১৮ পেয়েছেন।

কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, দেশের সবচেয়ে বড় মাল্টাবাগানের গর্বিত মালিক শাখাওয়াত। তাঁর উদ্যোগ ও সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে শিক্ষিত তরুণ-যুবকেরা মাল্টা উৎপাদনে এগিয়ে আসছেন। সাধারণ কৃষকেরাও সম্পৃক্ত হচ্ছেন।

দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ শামিউর রহমান জানান, দেশে বর্তমানে ফলের বিশাল বাজার রয়েছে। ফলমূল তুলনামূলকভাবে শিশু, গর্ভবতী ও প্রসূতি নারী এবং রোগীরা খেয়ে থাকেন। কিন্তু যেসব ফল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়, তা উৎপাদন ও সংরক্ষণে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। শাখাওয়াত হোসেন জৈব সার ও বালাইনাশক এবং ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে নিরাপদ উপায়ে মাল্টা উৎপাদন করছেন। সোলার পাম্পের সাহায্যে পানি উত্তোলন করে বাগানে পাইপলাইনে সেচ দিচ্ছেন। সরকারি কর্মচারী হয়েও কাজের ফাঁকে কৃষিতে মনোনিবেশ করে তিনি সারা দেশে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

গোড়ার গল্প
কৈশোর থেকেই গাছ লাগানোর নেশা শাখাওয়াতের। অপ্রচলিত বা নতুন কোনো ফল, ফুল বা ঔষধি গাছের সন্ধান পেলেই সংগ্রহ করে লাগাতেন। পরিত্যক্ত জমিতে এবং সরকারি রাস্তার দুই পাশে গাছ লাগিয়েছেন বছরের পর বছর। গাছ লাগানোর নেশা পিছু ছাড়েনি তাঁর। বৈচিত্র্যপূর্ণ গাছের সন্ধান পেলে এখনো ছুটে যান এবং চারা সংগ্রহ করে লাগিয়ে থাকেন।

পাবনার ঈশ্বরদীতে অবস্থিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মচারী শাখাওয়াত হোসেন ২০১৩ সালে খুলনায় পরমাণু চিকিৎসাকেন্দ্রে চাকরি করার সময় কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে বেড়াতে যান। টসটসে রসাল মাল্টার স্বাদে মুগ্ধ হন শাখাওয়াত। এরপর সেখান থেকে বারী-১ জাতের ২০টি মাল্টা চারা সংগ্রহ করে গ্রামের বাড়ি চুয়াডাঙ্গার ভগিরথপুরে নিয়ে লাগান। ২০১৫ সালে সব কটি গাছে ফল ধরলে তা দেখতে আশপাশের লোকজন ভিড় করতে থাকেন। এরপর এসব গাছ থেকে ডালকলম তৈরির পর পরিকল্পিতভাবে মাল্টা চাষে নামেন শাখাওয়াত। প্রথমেই ২০ বিঘা জমি বন্দোবস্ত নিয়ে মাল্টার বাগান তৈরি করেন। পরের বছর ৪০ বিঘা জমিতে চাষ করেন।

বাগানের পরিচর্যা ও মাল্টা বিপণনের জন্য পাঁচজন কর্মী কাজ করছেন। শাখাওয়াত জানান, বাগান তৈরি ও পরিচর্যার জনবল খরচ হিসেবে এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তবে মাল্টা ফল ও চারা বিক্রি করে অর্ধেকের বেশি টাকা উঠে গেছে। এ বছর পুরো খরচের টাকা উঠে অন্তত ১০ লাখ টাকা লাভের আশা করছেন তিনি। পরবর্তী বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য খরচ না থাকলেও প্রতিবছরে ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকার উপার্জন হবে বলে আশা শাখাওয়াতের।

থোকায় থোকায় স্বপ্ন
শাখাওয়াতের বিশাল মাল্টাবাগানে সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, গাছে গাছে থোকায় সবুজ রঙের মাল্টা ঝুলছে। বাতাস উঠলেই তালে তালে দোল খাচ্ছে মাল্টাগুলো।
শাখাওয়াত বলেন, থোকায় থোকায় মাল্টাগুলো তাঁর কাছে স্বপ্ন। তিনি জানালেন, গত বছর বড় গাছগুলোতে পরিপূর্ণ ফল ছিল ৬০০ থেকে ৬৫০। এ বছর কোনো কোনো গাছে ফলের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৭ সালে প্রথমবার বাগানে ফল ধরে। ১০০ মণ মাল্টা বিক্রি করা হয়। গত বছর বিক্রি করা হয় আরও ১৫০ মণ। এ বছর যে পরিমাণ ফুল ও ফল এসেছে, তাতে ভরা মৌসুমে ৫০০ মণ এবং মৌসুম ছাড়া আরও ১০০ মণ মাল্টা উৎপাদন হবে।

শাখাওয়াত জানান, গত বছর পাইকারি প্রতি মণ ৩ হাজার ২০০ টাকা (৮০ টাকা কেজি) ও মৌসুম ছাড়া প্রতিমণ ৭ হাজার ২০০ টাকা (১৮০ টাকা কেজি) দরে বিক্রি করা হয়েছিল। দেড় থেকে দুই মাস পর মাল্টা বিক্রির উপযোগী হবে। একই দাম থাকলেও এ বছরে মৌসুমে ১৬ লাখ এবং মৌসুম ছাড়া ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা মূল্যের ফল বিক্রি করা সম্ভব হবে। মাল্টাবাগানে ফাঁকে ফাঁকে লাগানো গৌঢ়মতি আম, উন্নত জাতের কুল ও পেঁপেগাছ রয়েছে। সাথি ফসল হিসেবে মুগ-কলাই, মরিচ ও শাকের খেত রয়েছে। এ ছাড়া বাগানের নার্সারিতে মাল্টা ছাড়াও উন্নত জাতের পেঁপে ও পেয়ারার চারা উৎপাদন ও বিক্রি করা হয়ে থাকে। এসব থেকেও বাড়তি আয় হয়ে থাকে শাখাওয়াতের।

পর্যটনের হাতছানি
চুয়াডাঙ্গা জেলা শহর থেকে সড়কপথে ভগিরথপুর অথবা হোগলডাঙ্গা গ্রাম হয়ে শাখাওয়াতের মাল্টাবাগানে যেতে হয়। হোগলডাঙ্গা গ্রাম থেকে নৌকায় এবং ভগিরথপুর থেকে গ্রামীণ রাস্তা ধরে বাগানে যাওয়া যায়। দেশের সবচেয়ে বড় এই মাল্টাবাগান দেখতে প্রায় প্রতিদিনই দূরদূরান্ত থেকে পর্যটনপ্রেমী মানুষ ছুটে আসেন। অনেকেই সপরিবারে আসেন এবং বাগানে ছবি তোলেন। গাছ থেকে সবুজ অথচ টসটসে রসে ভরা মাল্টা পেড়ে খান এবং বাড়ির যাওয়ার সময় কিছু কিনে নিয়ে যান। অনেকেই মাল্টার পাশাপাশি কয়েকটি চারাও কিনে নিয়ে যান নিজে লাগানোর জন্য।

শাখাওয়াত বলেন, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের নিয়মিত পরামর্শ ও সহযোগিতা পাচ্ছেন। এবার ১০ বিঘা জমিতে কমলাবাগান করবেন। চুয়াডাঙ্গা ছাড়াও পাবনা, নওগাঁ, গাইবান্ধা এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ মাল্টার চারা সংগ্রহ করতে আসেন। তিনি বলেন, ‘আমি চাই, সারা দেশে এই চাষ ছড়িয়ে যাক। তাহলে বিদেশ থেকে আর ফল আমদানি করা লাগবে না। মাল্টা চাষের মাধ্যমে দেশের কৃষি অর্থনীতি চাঙা হবে।