ধুনটে আ.লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে স্কুল বন্ধ রেখে মেলা চালানোর অভিযোগ

বগুড়ার ধুনট উপজেলায় বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে মাঠে চলছে মেলা। ছবি: মাসুদ রানা
বগুড়ার ধুনট উপজেলায় বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে মাঠে চলছে মেলা। ছবি: মাসুদ রানা

বগুড়ার ধুনট উপজেলার ভান্ডারবাড়ী সালেহা জহুরা উচ্চবিদ্যালয় ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ‘বন্ধ ঘোষণা’ করে মেলার আয়োজন করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। স্কুল মাঠে এ মেলার আয়োজনে উপজেলা প্রশাসনের আপত্তি থাকলেও পুলিশ প্রশাসন সেখানে ‘সহায়তা’ করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে দুই প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৯০০ শিক্ষার্থীর পাঠদান দুই দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। 

তিন দিনব্যাপী এই মেলা গতকাল সোমবার থেকে বিদ্যালয় দুটির মাঠে শুরু হয়েছে। জন্মাষ্টমী উপলক্ষে প্রতিবছর এই মেলার আয়োজন করা হয়। এবারে মেলা পরিচালনার জন্য ১০৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সভাপতি ভান্ডারবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আতিকুল করিম। মেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল বারীক। তিনি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তাঁদের সঙ্গে রয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগসহ সরকারদলীয় সংগঠনের প্রভাবশালী নেতারা।

বিদ্যালয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সালেহা জহুরা উচ্চবিদ্যালয়ে প্রায় ৬০০ শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য চারপাশে সীমানাপ্রাচীর দেওয়া হয়েছে। এই সীমানাপ্রাচীরের মধ্যেই বিদ্যালয়ের মাঠ। আর এই মাঠেই বসানো হয়েছে মেলা। এই বিদ্যালয়ের পূর্ব পাশেই রয়েছে ভান্ডারবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের আঙিনাও মেলা বসানো হয়েছে। মেলার কারণে দুটি প্রতিষ্ঠানে গতকাল থেকে বন্ধ রয়েছে পাঠদান।

গতকাল সোমবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠ দোকানিদের দখলে। কোথাও পা রাখার জায়গা নেই। গত রোববার বিকেল থেকে তাঁরা বাঁশের খুঁটি দিয়ে দোকানঘর নির্মাণ করছেন। পলিথিন দিয়ে বেড়া দেওয়া হয়েছে। তবে বন্ধ রয়েছে বিদ্যালয়ের পাঠদান কক্ষগুলো। খোলা নেই বিদ্যালয়ের কার্যালয়ও। বিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষকও আসেননি। স্থানীয় লোকজন বলছেন, সোমবার থেকে এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আসেনি। এই সুযোগে শিক্ষকেরাও অঘোষিত ছুটিতে রয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলী সিদ্দীকি বলেন, মেলা বসানোর কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। এই বিষয়ে উপজেলা প্রশাসকে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে মেলার কারণে স্কুলে পাঠদানের পরিবেশ না থাকায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। শিক্ষকেরা ছুটিতে আছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি ছুটিতে আছি।’ বর্তমানে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে রয়েছেন সহকারী প্রধান শিক্ষক নিবারণ চন্দ্র। এই বিষয়ে তাঁর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও মোবাইল বন্ধ পাওয়া গেছে।

এদিকে মেলার কারণে বন্ধ রয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদানও। এখানে ২০৮ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। মঙ্গলবার দুপুরে গিয়ে দেখা গেছে, বিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষার্থী নেই। মাঠে বসানো হয়েছে আসবাবের দোকান। বারান্দায়ও রাখা হয়েছে আসবাব। তবে খোলা ছিল বিদ্যালয়ে কার্যালয়। রয়েছেন সহকারী প্রধান শিক্ষক আশা বালা। তিনি বলেন, বিদ্যালয়ের মাঠে মেলার বিষয়ে তাঁর কিছু জানা নেই। আশা বালার সঙ্গে কথা বলতেই এই কক্ষে প্রবেশ করলেন বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম। তিনিও মেলা কমিটির সদস্য। স্কুল ছুটি রেখে মেলা পরিচালনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে মেলা চালানো হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন।

তিন দিনের এই মেলার কারণে প্রায় চার দিন ক্লাস বন্ধ থাকে স্কুল দুটির। ছবি: মাসুদ রানা
তিন দিনের এই মেলার কারণে প্রায় চার দিন ক্লাস বন্ধ থাকে স্কুল দুটির। ছবি: মাসুদ রানা

তবে ধুনট উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা কামরুল হাসান বলছেন, এই ধরনের মেলার কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। স্কুল বন্ধ করে মেলা করার কোনো প্রশ্নই আসে না। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ভান্ডারবাড়ী সালেহা জহুরা উচ্চবিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, বিদ্যালয়ের মাঠে মেলা দেখার নামে বহিরাগত যুবকেরা জমায়েত হয়েছে। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা মাঠ দখল করে মেলা বসিয়েছেন। ক্লাসও হয় না। এই কারণে তারা বিদ্যালয়ে যায় না। মেলা উপলক্ষে তিন থেকে চার দিন কোনো ক্লাস হয় না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের কয়েকজন স্থানীয় নেতা বলেন, পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় এই মেলা হচ্ছে।

মেলা কমিটির সভাপতি আতিকুল করিম বলেন, এটি ঐতিহাসিক মেলা। অনেক দিন ধরেই এখানে মেলার আয়োজন করা হয়। অন্য কোথাও জায়গা না থাকায় বিদ্যালয়ের মাঠে মেলা বসানো হয়েছে।

মেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল বারীক বলেন, উপজেলা প্রশাসন ও শিক্ষা কার্যালয়কে অনুরোধ করে এক দিনের জন্য বিশেষ ছুটির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম জিন্নাহ বলেন, বিদ্যালয়ের মাঠে মেলার বিষয়টি তাঁর জানা নেই। বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ভান্ডারবাড়ী সালেহা জহুরা উচ্চবিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি রাজিয়া সুলতানা বলেন, মেলা বসানোর আবেদন করা হয়েছিল গত পরশু। স্কুলের মাঠে মেলা বসাতে নিষেধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে এখানে মেলা বসালে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য থানা-পুলিশ প্রশাসনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

উপজেলা প্রশাসন মেলা বসানোর বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও স্কুল বন্ধ রেখেই মাঠে চলছে মেলা। জানতে চাইলে ধুনট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘শুনেছি সেখানে এক দিনের মেলা বসেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পুলিশ চাইলে আমি দেব। ভ্রাম্যমাণ আদালত চালালে আমি সহায়তা করব।’