পুলিশের ভূমিকা নিয়ে মাদ্রাসাছাত্রীর পরিবারে ক্ষোভ

সোনাগাজীর সেই মাদ্রাসাছাত্রী। ছবি: সংগৃহীত
সোনাগাজীর সেই মাদ্রাসাছাত্রী। ছবি: সংগৃহীত
>
  • হামলাকারী শম্পার গ্রেপ্তার নিয়ে বিভ্রান্তি
  • থানা পুলিশ ও ডিআইজির দুরকম বক্তব্য 
  • ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ
  • মামলার এজাহার পরিবর্তন

ফেনীর সোনাগাজীর অগ্নিদগ্ধ মাদ্রাসাছাত্রীর ওপর হামলাকারী সেই ‘শম্পা’কে গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া গেছে। তিনি অভিযুক্ত অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার নিকটাত্মীয়। অগ্নিদগ্ধ ছাত্রী গত রোববার চিকিৎসকদের বলেছিলেন, তাঁর ওপর হামলা করেছিলেন চারজন। এঁদের মধ্যে দুজন নারী, একজনের নাম শম্পা।

চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) খন্দকার গোলাম ফারুক গতকাল সোনাগাজীতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, শম্পা নামের যে হামলাকারীর কথা অগ্নিদগ্ধ মাদ্রাসাছাত্রী বলেছেন, সেই শম্পাকে পুলিশ গতকাল মঙ্গলবার সকালে সোনাগাজীর মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর থেকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে সোনাগাজী থানার পুলিশ বলছে, গ্রেপ্তারকৃত নারীর নাম উম্মে সুলতানা ওরফে পপি।

এই দুরকম বক্তব্যে শম্পার গ্রেপ্তার নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। গতকাল রাতে ডিআইজি ফারুকের কাছে জানতে চাওয়া হয়, আপনি এবং থানা-পুলিশ দুরকম নাম বলছেন কেন? জবাবে তিনি বলেন, ঠিকই আছে। ওই পপিই শম্পা।

এদিকে মাদ্রাসাছাত্রীটির পরিবার বলছে, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের প্রতি তারা আস্থা রাখতে পারছে না। হাত-পা বেঁধে কেরোসিন ঢেলে মেয়েটিকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনাকে পুলিশ ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এমনকি মামলার এজাহার নিয়েও পুলিশ কূটচাল চেলেছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে গতকাল ওই ছাত্রীর স্বজনেরা বলেন, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কার স্বার্থে কাজ করছেন, তা তদন্ত করে দেখা দরকার। নইলে আসল অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে না।

এই অনাস্থার কারণ কী জানতে চাইলে ছাত্রীর ভাই প্রথম আলোকে বলেন, ২৭ মার্চ মাদ্রাসা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করার পর থেকে ওসি বলে আসছেন, শ্লীলতাহানির অভিযোগ সাজানো। তাঁর বোন নাটক করছেন। মামলা দায়েরের পর থেকে তাঁদের হুমকি দেওয়া হয়েছে। এমনকি ৬ এপ্রিল তাঁর বোনকে হত্যাচেষ্টার ঘণ্টা দেড়েক আগেও মাদ্রাসার ইংরেজির প্রভাষক আফছারউদ্দীন মামলা তুলে নিতে চাপ দেন। হত্যাচেষ্টার ৩০ ঘণ্টা পর ওসি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে বলেছেন, এটা হত্যাচেষ্টা না আত্মহত্যার চেষ্টা, তা তদন্ত করে দেখতে হবে। সর্বশেষ ৮ এপ্রিল তিনি যে মামলা সাজিয়ে পাঠিয়েছেন, সেখানেও তথ্য গোপনের চেষ্টা করেছেন। পরিবারের দাবির মুখে শেষ পর্যন্ত মামলার এজাহার বদলানো হয়েছে।

কীভাবে তথ্য গোপনের চেষ্টা হয়েছে জানতে চাইলে স্বজনেরা বলেন, ৬ এপ্রিল রাতেই সোনাগাজী থানার উপপরিদর্শক ইকবাল আহমেদ ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের চিকিৎসকের অনুমতি নিয়ে ছাত্রীটির সাক্ষাৎকার নেন। তিনি সেই সাক্ষাৎকার রেকর্ড করেন এবং তাঁদের পড়ে শোনান। কিন্তু মঙ্গলবার পুলিশ ঢাকায় এসে যে এজাহারে মেয়েটির ভাইয়ের স্বাক্ষর নেন, তাতে দেখা যায় ঘটনাস্থল লেখা হয়েছে ভুলভাবে। মেয়েটিকে হাত-পা বেঁধে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ আসেনি এবং কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ আসামির নাম বাদ গেছে। প্রথম এজাহারে মাদ্রাসার অধ্যক্ষকে বাদ রেখে অজ্ঞাতনামা চার নারীসহ নয়জনকে আসামি করা হয়। পরে অগ্নিদগ্ধ মাদ্রাসাছাত্রীর পরিবারের দাবির মুখে সোনাগাজী পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, মাদ্রাসার আলিম শ্রেণির ছাত্র জোবায়ের আহমেদ ও মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণাধীন হেফজখানার হাফেজ আবদুল কাদেরকে আসামি করা হয়।

তা ছাড়া এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, থানা-পুলিশ বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বার্তা পাঠিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মানববন্ধন বা অন্য কর্মসূচি পালন না করতে বলেছেন।

তবে থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মেয়েটি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন, এ কথা তিনি বলেননি। বরং অধ্যক্ষসহ ১০ জনকে আটক করা হয়েছে। পুলিশ আসামি ধরার চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিআইজি গোলাম ফারুক বলেন, দায়িত্বশীল চেয়ারে থেকে এমনটি করার সুযোগ নেই। ঘটনাটি নৃশংস এবং দায়ী ব্যক্তিরা অবশ্যই আইনের আওতায় আসবে।

এ ঘটনায় আটক চারজনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে গতকাল ফেনীর আদালতে পাঠানো হয়েছে। জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম শরাফ উদ্দিন আহমেদ চারজনকেই পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এঁরা হলেন নুর হোসেন, কেফায়েত উল্যাহ, সাইদুল ইসলাম ও আলাউদ্দিন। এঁরা অধ্যক্ষের অনুগত হিসেবে পরিচিত।

পুলিশ সূত্র জানায়, আটক মাদ্রাসার অফিস সহকারী নুরুল আমিন জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, এর আগেও অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছিল। তদন্ত কমিটি গঠনের পর ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায়। গত ২৭ মার্চ তিন ছাত্রীকে অধ্যক্ষ তাঁর দপ্তরে ডেকে পাঠান। কিন্তু ঢুকতে দেওয়া হয় একজনকে। কিছুক্ষণ পর অধ্যক্ষ কলবেল চাপেন। তিনি ভেতরে গিয়ে দেখেন, ছাত্রীটি (পরে অগ্নিদগ্ধ) মেঝেতে মাথা নিচু করে বসে আছেন। তিনি ছাত্রীটিকে বের করে আনেন। বাইরে অপেক্ষায় থাকা দুই বান্ধবীকে দেখে তিনি কাঁদতে শুরু করেন।

নুরুল আমিন আরও জানান, একসময় জামায়াতের নেতা হলেও সোনাগাজীতে সিরাজ উদ দৌলার প্রভাব রয়েছে। তাঁর পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে সরকারি দলের কিছু লোকও আছেন। তবে পৌরসভার মেয়র রফিকুল ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগের কেউ অধ্যক্ষকে সমর্থন দিচ্ছেন না। অবশ্য মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদে আওয়ামী লীগের দু-একজন নেতা আছেন। তাঁদের সঙ্গে অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকতে পারে।

পরিকল্পিত হত্যাচেষ্টা বলছেন স্থানীয়রা
সোনাগাজী সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সামছুল আরেফিন অগ্নিদগ্ধ ছাত্রীর ওপর হামলার ঘটনাকে পরিকল্পিত বলে অভিহিত করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মাদ্রাসার অধ্যক্ষের একটি পেটোয়া বাহিনী আছে। এরাই এ নৃশংস ঘটনায় জড়িত। অধ্যক্ষের অনুগত লোকজনকে ধরলে হত্যাচেষ্টাকারী লোকজনের পরিচয় পাওয়া যাবে। আর বোরকা পরিহিত চারজনের মধ্যে পুরুষ সদস্যও থাকতে পারে। সামছুল আরও বলেন, এ ঘটনায় কেউ যেন রাস্তায় না নামে, সে জন্য লোকজনকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কারা করেছে জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের বিষয়টি খুঁজে দেখার কথা বলেন।

হাসপাতালে অস্ত্রোপচার
মেয়েটিকে এখনো কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস ব্যবস্থায় রাখা হয়েছে। এই অবস্থায় গতকাল মাদ্রাসাছাত্রীর অস্ত্রোপচার হয়েছে। চিকিৎসকেরা বলেছেন, মারাত্মক যন্ত্রণায় ভোগা মেয়েটিকে স্বস্তি দিতে যা করা প্রয়োজন, তাই করছেন তাঁরা। অস্ত্রোপচার শেষে দুপুরের দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার নাসিরউদ্দীন বলেন, মেয়েটির শরীরে বেশ কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে। রক্ত ও ফুসফুসে সংক্রমণ ছাড়াও কিডনিতে কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল জানিয়েছে, রোগীর এখন যে অবস্থা, তাতে এ মুহূর্তে দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া যাবে না।

অন্যদিকে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের বিভাগীয় প্রধান আবুল কালাম বলেন, ফুসফুসকে সক্রিয় করতে অস্ত্রোপচারটি করা হয়েছে সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের পরামর্শেই। পূর্বনির্ধারিত একটি কর্মসূচির অংশ হিসেবে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকদের ঢাকায় আসার কথা রয়েছে ১৪ এপ্রিল। তাঁরা এসে রোগী দেখবেন।

{প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সোনাগাজী প্রতিনিধি}