মিলল শতবর্ষী হওয়ার প্রমাণ

সিলেটের ঐহিত্যবাহী আবু সিনা ছাত্রাবাসে পাওয়া গেছে ১৮৮০ সালে স্থাপিত একটি স্মৃতিফলক। সেটি দেখছেন শতবর্ষী ভবনটি রক্ষা আন্দোলনের এক সংগঠক। গতকাল দুপুরে।  প্রথম আলো
সিলেটের ঐহিত্যবাহী আবু সিনা ছাত্রাবাসে পাওয়া গেছে ১৮৮০ সালে স্থাপিত একটি স্মৃতিফলক। সেটি দেখছেন শতবর্ষী ভবনটি রক্ষা আন্দোলনের এক সংগঠক। গতকাল দুপুরে। প্রথম আলো

সিলেটে আবু সিনা ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহৃত ভবনটি শতবর্ষী। এ কথা বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্তের ওপর ভর করে বলা হচ্ছিল। এবার মিলল একটি নিদর্শনও, ভবনের দেয়ালে প্রাচীন স্লেট পাথরে খোদাই করা একটি স্মৃতিফলক (এপিটাফ)। ১৮৮০ সালের ৭ জুন স্মৃতিফলকটি স্থাপন করা হয়। ভবনটির একটি কক্ষের পাশের দেয়ালে সাঁটানো রয়েছে সেটি।

শতবর্ষী ভবনটি সুরক্ষার দাবিতে আন্দোলনত নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা গতকাল বুধবার ছাত্রাবাসে যান। তাঁরা স্থপতিদের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছেন, স্মৃতিফলকটি প্রাচীন স্লেট পাথরের তৈরি। স্থপতিরা বলছেন, ১৮৮০ সালে স্মৃতিফলকটি স্থাপন করা হয়েছিল। তাই ভবনটি যে তারও আগে নির্মিত, এ ব্যাপারে আর কোনো দ্বিধা থাকল না। তাঁদের ধারণা, সিপাহি বিদ্রোহের আগে–পরে ভবনটি নির্মিত হতে পারে। এমনটি হলে ভবনটি দুই শ বছরের কাছাকাছি বয়সী একটি স্থাপনা। সে হিসেবে এটি ভারতবর্ষের জন্যও একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন।

এই স্মৃতিফলকের মধ্য দিয়ে ভবনটি যে শতবর্ষী, তার একটি স্পষ্ট নিদর্শন মিলল বলে মনে করছেন ‘সিলেটের ঐতিহ্য রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ নাগরিক সমাজ’-এর একজন সংগঠক আবদুল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, গত মঙ্গলবার শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ মৃগেন কুমার চৌধুরী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্মৃতিফলকের ছবি দিয়ে একটি লেখা পোস্ট করেন। ‘কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল’ শিরোনামের ওই লেখায় স্মৃতিফলকটি ছাত্রাবাসের দেয়ালে সাঁটানো আছে বলে জানানো হয়। এরপর নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা গতকাল সেখানে যান। তাঁরা স্মৃতিফলকটির ছবি নিয়ে স্থপতিদের দেখান। স্থপতিরা এটি দেড় শতাধিক বছরের নিদর্শন হিসেবে নিশ্চিত করেছেন।

এ প্রসঙ্গে আবদুল করিম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা এত দিন কাগুজে তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বলেছিলাম, ভবনটি শতবর্ষী। কোনো স্থাপনা শতবর্ষ অতিক্রম করলে পুরাকীর্তি হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংরক্ষণ তালিকায় আসে। গণপূর্ত অধিদপ্তর প্রকল্পটি বাস্তবায়নের আগে এ বিষয়ে কেন গণশুনানি করল না, এটিই দেখার বিষয়।’

গতকাল বিকেলে আবু সিনা ছাত্রাবাসে গিয়ে দেখা গেছে, একটি কক্ষের পাশের দেয়ালে সাঁটানো রয়েছে স্মৃতিফলকটি। তাতে ‘ইন মেমোরি অব বাবু সারদা নাথ গুহ’ নামে ওই সময়ের এক চিকিৎসকের মৃত্যুতে স্মৃতিকথা শোভা পাচ্ছে। খোদাই করে লেখাগুলো এখনো পাঠোদ্ধারের অবস্থায় রয়েছে। ইংরেজি ও বাংলায় কথাগুলো স্লেট পাথরে খোদাই করে লেখা।

সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক রাজন দাশ স্মৃতিফলকটি দেখে প্রথম আলোকে বলেন, ওই সময় স্লেট পাথরে এপিটাফ লেখার প্রচলন ছিল। এটি ব্রিটিশ সংস্কৃতির একটি অংশ। স্লেট পাথরে খোদাই করে সন-তারিখ লেখা থাকায় স্বাভাবিকভাবেই বলা যাচ্ছে, ভবনটি কমবেশি দুই শ বছরের পুরোনো। কেননা, ওই চিকিৎসক ১৭ বছর সেখানে চিকিৎসাসেবা দিয়েছিলেন। তাঁর ভাষ্য, এত পুরোনো ভবন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকার বাইরে থাকা এবং গণপূর্ত ভবনটি ভাঙতে প্রস্তুত থাকার বিষয়টি আসলে বিস্ময়কর।

এ ব্যাপারে কথা বলতে গণপূর্ত অধিদপ্তর সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী কুতুব আল হোসাইনের মুঠোফোন নম্বরে গতকাল একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি। দপ্তরে গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে হাসপাতাল প্রকল্পের কাজ শুরুর সময় তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ভবনটি পুরাকীর্তির কোনো তালিকাতে নেই। সংরক্ষণ করা যাবে, এমন ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাও নেই। জরাজীর্ণ, ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক ছিল। যেকোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনার শঙ্কাও ছিল।

সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহৃত শতবর্ষী ভবনটির অবস্থান সিলেট নগরের কেন্দ্রস্থল চৌহাট্টা এলাকায়। ২৫০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণে ভবনটি ভেঙে আটতলার নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অর্থায়নে গণপূর্ত সম্প্রতি এ কাজ শুরু করেছে।

শতবর্ষী ভবনটি স্থাপনের সময়কাল চিহ্নিত না থাকায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এ বিষয়ে অবহিত ছিল না। ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত সিলেটের প্রথম সংবাদপত্র শ্রীহট্ট প্রকাশ-এর ছাপাখানা থাকার বিষয়টি বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্যের মাধ্যমে নিশ্চিত হলে ভবনটি রক্ষার দাবি ওঠে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং লিডিং ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সিলেটের আদি কাঠামোর ঐতিহ্য হিসেবে ভবনটি রক্ষার দাবি জানান।

এ নিয়ে ধারাবাহিক কিছু কর্মসূচির পর পুরাকীর্তি আইন ১৯৬৮ অনুযায়ী শতবর্ষী ভবন ভাঙা বেআইনি কাজ হিসেবে হাসপাতাল প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সিলেট-১ আসনের সাবেক সাংসদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে অবহিত করেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। গত ২৪ মার্চ তিনি সরেজমিন পরিদর্শন করে শতবর্ষী ভবনটি রক্ষার আশ্বাস দেন। তবে ৩০ মার্চ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সিলেটের একটি অনুষ্ঠানে হাসপাতাল প্রকল্প বাস্তবায়িত না হলে টাকা ফেরত যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ আশঙ্কা প্রকাশের পর পক্ষে ও বিপক্ষে তৎপরতা শুরু হয়। শতবর্ষী ভবন সুরক্ষা, ভবন ভেঙে হাসপাতাল স্থাপনের দাবিতে আরও একটি পক্ষ এবং সর্বশেষ ঐতিহ্য রক্ষা করে ওই এলাকায় হাসপাতাল স্থাপনের দাবিতে তৃতীয় একটি পক্ষও সক্রিয় হয়। এ অবস্থায় শতবর্ষী ভবন রক্ষার দাবিতে সোচ্চার নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে গত রোববার স্থপতিদের আহ্বান–সংবলিত একটি মতবিনিময় সভা হয়। আজ বৃহস্পতিবার ঢাকায় রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে ‘সিলেটের ঐতিহ্য রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ নাগরিক সমাজ’ সংবাদ সম্মেলন করে শতবর্ষী ভবন রক্ষার দাবিটি কেন্দ্রীয়ভাবে উপস্থাপন করবে।