যাত্রীদের জিম্মি করে চাপ সামলাতে চায় মালিক-শ্রমিকেরা

গণপরিবহন অপেক্ষাকৃত কম থাকায় বিপাকে অফিস–ফেরত মানুষ। গাড়ি পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হয় তাঁদের। গতকাল বিকেলে রাজধানীর ফার্মগেটে।  ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
গণপরিবহন অপেক্ষাকৃত কম থাকায় বিপাকে অফিস–ফেরত মানুষ। গাড়ি পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হয় তাঁদের। গতকাল বিকেলে রাজধানীর ফার্মগেটে। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
>
  • আবরারের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা দেওয়ার নির্দেশ
  • পা হারানো রাসেলকে ৫০ লাখ টাকা দিতে নির্দেশ
  • দুর্ঘটনার পর আদালতের রায় দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে
  • রায়–সরকারি তৎপরতায় চাপে মালিক-শ্রমিকনেতারা
  • কয়েক দিন ধরে বাস-মিনিবাসের চলাচল নিয়ন্ত্রণ
  • বাস কম থাকায় ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা

আদালত থেকে দুই পরিবহন কোম্পানিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশে চাপে পড়েছে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো। আবার সড়কে শৃঙ্খলা আনতে ভ্রাম্যমাণ আদালত ও পুলিশও সক্রিয় হয়েছে। এ অবস্থায় চাপ সামলাতে পুরোনো কায়দায় যাত্রীদের জিম্মি করার কৌশল শুরু করেছেন মালিক-শ্রমিকেরা। গতকাল বুধবার মালিক-শ্রমিকেরা রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশে বাস-মিনিবাসের চলাচল কমিয়ে দেন। এতে ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা।

সুপ্রভাত পরিবহনের বাসের চাপায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী মারা যাওয়ার পর তাঁর পরিবারকে তাৎক্ষণিক ১০ লাখ টাকা দেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত। বাসের চাপায় প্রাইভেট কারের চালক রাসেল সরকার পা হারানোর ঘটনায় আদালত তাঁকে ৫০ লাখ টাকা দিতে গ্রিন লাইন পরিবহন কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। গতকাল ৫ লাখ টাকা পরিশোধ করে গ্রিন লাইন কর্তৃপক্ষ। বাকি ৪৫ লাখ টাকা এক মাসের মধ্যে দিতে আদেশ দেন আদালত।

পরিবহন মালিক-শ্রমিক সূত্রগুলো বলছে, দুর্ঘটনার পর এভাবে আদালতের রায় দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পরবর্তী সময়ে আবারও এমন কোনো দুর্ঘটনার পর কেউ মামলা করলে আদালত জরিমানা করবেন। সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাসের চাপায় আবরার আহমেদ চৌধুরী মারা যাওয়ার পর মালিক-চালককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ছাত্র আন্দোলনের ভয়ে সুপ্রভাত ও জাবালে নূর পরিবহনের সব বাসের চলাচলের অনুমোদনও বাতিল করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। আবার বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানও জোরদার হয়েছে। গতকাল সংস্থাটির ১১ জন নির্বাহী হাকিমের আদালত ৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকা জরিমানা করেন। দুটি যান জব্দ করেন। আদালতের রায় ও সরকারের তৎপরতায় চাপ অনুভব করছে মালিক–শ্রমিকনেতারা। এ জন্য সর্বত্র পরিবহন ধর্মঘট দেওয়া না দেওয়া নিয়ে তাঁদের কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে। পরিস্থিতি সামলাতে মালিক–শ্রমিকেরা কয়েক দিন ধরেই ঢাকা ও এর আশপাশে পরিকল্পিতভাবে বাস-মিনিবাসের চলাচল নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন। গতকাল রাজধানী ও এর আশপাশে অন্তত ৩০ শতাংশ বাস-মিনিবাস চলেনি।

মালিকদের হয়ে ঢাকাসহ সারা দেশের পরিবহন খাতের বেশির ভাগের নিয়ন্ত্রণ করেন খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ ও মসিউর রহমান। এনায়েত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। আর মসিউর রহমান জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও গত সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। সারা দেশে শ্রমিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী প্রথম আলোকে বলেন, চালক দুর্ঘটনা ঘটালে তাঁদের পরিবারের সবাইকে হয়রানি করা হচ্ছে। সড়ক পরিবহন আইনে অজামিনযোগ্য ধারা যোগ করা হয়েছে। পথে পথে হয়রানির শিকার হচ্ছেন চালক। এ অবস্থায় যেকোনো সময় রাজধানী ও দূরপাল্লার পথে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

তবে দূরপাল্লার পথে কোনো সমস্যা নেই বলে মনে করেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গ্রিন লাইন পরিবহনের বিরুদ্ধে আদালত যে ক্ষতিপূরণের রায় দিয়েছেন, এটা নিয়ে মালিক সমিতিতে আলোচনা হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়ায় এটা মোকাবিলা করা হবে। আর পুলিশ-বিআরটিএর কড়াকড়ির কারণে ঢাকায় কিছুটা পরিবহন সংকট হয়েছে। কারণ, অনেক বাসেরই চলাচলের অনুমতি (রুট পারমিট) ও ফিটনেস সনদে ঝামেলা রয়েছে।

গতকাল বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর কল্যাণপুর, শ্যামলী ও আসাদগেট এলাকায় অনেক যাত্রীকে বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায়। মাঝেমধ্যে একটা বাস এলেও সেগুলোর দরজা বন্ধ করা। গতকাল এইচএসসি পরীক্ষা ছিল। দুপুরের দিকে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা বের হওয়ার পর সংকট আরও বেড়ে যায়। বেলা একটার দিকে শুক্রাবাদ, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, নিউমার্কেট এলাকায় প্রচুর যাত্রীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

গাজীপুরের চন্দ্রা থেকে সাভার, মিরপুর রোড ও বকশীবাজার হয়ে নারায়ণগঞ্জ পথে চলে মৌমিতা পরিবহন। গতকাল দুপুরে নীলক্ষেতে এই কোম্পানির একটি বাস এলে বেশ কিছু নারী-শিক্ষার্থী দরজা ধাক্কাতে থাকেন। তাঁরা আকুতি করতে থাকেন যে দুই ঘণ্টা ধরে বাসে উঠতে পারছেন না। দরজা খুলে যেন তাঁদের নেওয়া হয়। অবশ্য বাসটির ভেতরে যাত্রীরা গাদাগাদি করেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরপরও কয়েকজন যাত্রী বাইরে থাকা নারী-শিক্ষার্থীদের উঠিয়ে নিতে অনুরোধ করলে দরজা খোলা হয়।

মৌমিতা পরিবহনের কন্ডাক্টর সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদেরসহ অন্য কোম্পানির অনেক বাস চলাচল বন্ধ আছে। এ জন্যই সংকট। তাঁর দাবি, পুলিশের কড়াকড়ির কারণে দরজা বন্ধ করে চালাচ্ছেন।

বিকেলের দিকে প্রেসক্লাবের সামনে, পল্টন মোড় ও শাহবাগেও বাস-মিনিবাসের সংকট দেখা গেছে। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে শাহবাগে আফরোজা সাইদ নামের অপেক্ষমাণ যাত্রী বলেন, তিনি মিরপুরের পল্লবী যাবেন। এক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছেন। এরই মধ্যে কয়েকটা বাস এসেছে। কিন্তু এতে দু-একজন পুরুষ ছাড়া নারীদের ওঠার মতো অবস্থা ছিল না।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পরিবহনমালিক–শ্রমিকেরা কোনো কিছুই পরোয়া করেন না। কথায় কথায় যাত্রীদের জিম্মি করেন। ছাত্র আন্দোলন ও আদালতের রায়ের কারণে এবার হয়তো তাঁদের ওপর কিছুটা চাপ পড়েছে। এটা অব্যাহত রাখতে হবে। আইনিকাঠামোও জোরদার করতে হবে।