গর্জে ওঠো বাংলাদেশ

নুসরাত জাহান।
নুসরাত জাহান।

‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।’ বাংলাদেশ, তুমি জাগো, তুমি রুখে দাঁড়াও। আমাদের আঠারো বছরের শিক্ষার্থীটির কী অপরাধ? তার কি এই অপরাধ যে সে মেয়ে হয়ে জন্মেছে? নাকি তার অপরাধ সে জন্মেছিল বাংলাদেশে?

নুসরাত জাহানের মতো এমন নিষ্পাপ মুখ কখনো দেখেছি কি? তাঁর ক্লান্ত করুণ মুখের নিচে পুড়ে যাওয়া সমস্তটা শরীর। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে করতে হেরে যাওয়া আমাদের এই কন্যা বলছেন, ‘কী করেছ তোমরা আমাকে? কেন করেছ?’

পত্রিকান্তরে ফেনীর সোনাগাজীর ওই মাদ্রাসাছাত্রীর দুটো লেখা ছাপা হয়েছে। নুসরাত লিখেছেন, ‘আমি লড়ব শেষনিশ্বাস পর্যন্ত। আমি প্রথমে যে ভুলটা করেছি আত্মহত্যা করতে গিয়ে, সেই ভুলটা দ্বিতীয়বার করব না। মরে যাওয়া মানেই তো হেরে যাওয়া। আমি মরব না। আমি বাঁচব। আমি তাকে শাস্তি দেব, যে আমায় কষ্ট দিয়েছে। আমি তাকে এমন শাস্তি দেব যে তাকে দেখে অন্যরা শিক্ষা নেবে।’

কাকে তিনি শাস্তি দিতে চাইছেন? কেন? তারও বর্ণনা নুসরাত লিখে রেখেছেন আরেকটা লেখায়। বান্ধবীদের চিঠি লেখার মতো করে তিনি লিখেছেন, ‘তামান্না, সাথী। তোরা আমার বোনের মতো এবং বোনই। ওই দিন তামান্না আমায় বলেছিল, আমি নাকি নাটক করতেছি। তোর সামনেই বলল। আরও কী কী বলল। আর তুই নাকি নিশাতকে বলেছিলি, আমরা খারাপ মেয়ে। বোন, প্রেম করলে কি সে খারাপ??? তোরা সিরাজ উদ দৌলা সম্পর্কে সব জানার পরও কীভাবে তার মুক্তি চাইতেছিস? ওনি আমার কোন জায়গায় হাত দিয়েছে আর কোন জায়গায় হাত দেওয়ার চেষ্টা করছে, উনি আমায় বলতেছে, নুসরাত ঢং করিস না। তুই প্রেম করিস না। ছেলেদের সাথে প্রেম করতে ভালো লাগে। ওরা তোরে কী দিতে পারবে? আমি তোরে পরীক্ষার সময় প্রশ্ন দেব।’

ঘটনাক্রম এই: ২৭ মার্চ সোনাগাজীর নিজ মাদ্রাসার খুবই প্রভাবশালী অধ্যক্ষ তাঁর ছাত্রী নুসরাতকে কক্ষে ডেকে নিয়ে গিয়ে এসব ঘটান। সাহসী মেয়েটি এই জুলুম মেনে নেননি। তিনি পরিবারকে জানান। মেয়েটির পরিবার মামলা করে। মাদ্রাসার অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৬ এপ্রিল ২০১৯ ঘটে পৃথিবীর নৃশংসতম ঘটনাটি। মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষার আরবি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে যান নুসরাত। পরীক্ষা শুরুর আগে হল থেকে ছাদে নিয়ে যাওয়া হয় নুসরাতকে। বোরকা, নেকাব আর হাতমোজা পরা চারজন নুসরাতকে চাপ দেয় অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে করা মামলা তুলে নিতে। নুসরাত অস্বীকৃতি জানালে তাঁর শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। সারা শরীরে আগুনের লেলিহান শিখা নিয়ে নুসরাত ছুটে আসেন নিচতলায়।

তাঁর শরীরের ৮০ ভাগ পুড়ে গিয়েছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে চেপে বসা মরণকষ্ট সইতে সইতে নুসরাত বলেন, ‘আমি সারা বাংলাদেশের কাছে বলব, প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলব, সারা দুনিয়ার কাছে বলব, এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করব।’

নুসরাত ১০ এপ্রিল তাঁর শেষ নিশ্বাসটুকু ছেড়েছেন পৃথিবীর আকাশে-বাতাসে। তিনি আর জাগবেন না। অসহ্য যন্ত্রণা থেকে তিনি মুক্তি পেলেন। কিন্তু আমাদের ওপরে রেখে গেলেন একটি কর্তব্য—প্রতিবাদের। তিনি বাংলাদেশকে বলে গেছেন, প্রতিবাদ করো। প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলে গেছেন, প্রতিকার করুন। সারা পৃথিবীকে বলে গেছেন, জাগো পৃথিবী, এমন ব্যবস্থা করো, যেন আর কোনো ছেলে বা মেয়ে কোথাও নিগৃহীত না হয়!

আমরা নুসরাতের হয়ে ওর কথাটা ভাবার চেষ্টা করি। অতটুকুন মেয়েটি পুরুষতন্ত্রের দুর্ভেদ্য কারাগারের অলঙ্ঘ্য প্রাচীরের মধ্যে থেকেও কী তেজোদ্দীপ্ত লড়াইটাই না করলেন। ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ কতই না শক্তিশালী। তাঁর আছে ক্ষমতা, আছে অর্থ, আছে প্রতিষ্ঠান, আছে ব্যবস্থা। তাঁর পক্ষে আছে সামাজিক সংস্কার, পুরুষবাদের আধিপত্যময় লৌহথাবা। আর মেয়েটি কিনা প্রতিবাদ করেছেন সেই অধ্যক্ষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে। আমি সালাম জানাই তাঁর পরিবারকে। যারা তাঁকে ‘চুপ করে থাক’ না বলে মামলা করার সাহস দেখিয়েছিল।

১৮ বছরের সামান্য জীবন নুসরাতের, কিন্তু জাগ্রত বিবেক নিয়ে লড়ে গেলেন শেষনিশ্বাস ত্যাগ না করা পর্যন্ত।

বাংলাদেশ, তুমি এখন দেখিয়ে দাও, তুমি অন্যায়ের পক্ষে নও। তুমি মানুষের পক্ষে, মানবিকতার পক্ষে, বিবেকের পক্ষে। আমাদের ওপর চেপে বসা পুরুষতন্ত্র আর জুলুমের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ, তুমি এই ঘাতকদের আইনের আওতায় নাও। সবার সামনে দৃষ্টান্তমূলক বিচার করো। বাংলাদেশ, তুমি বাংলাদেশ হয়ে ওঠো।