'জাহাজ বিল্ডিং' নামের মাহাত্ম্য তাহলে এই

এক পাশে রাস্তা। পাশেই লম্বা আকৃতির ভবন। নাম ‘জাহাজ বিল্ডিং’। এমন নামকরণ ভবনটির অবকাঠামোগত কারণে। এলাকাবাসী এমনটিই জানতেন। কিন্তু রাস্তার পাশ দিয়ে প্রবহমান একটি ছড়া উদ্ধার করতে গিয়ে যেন বের হলো ওই নামকরণের আরও এক মাহাত্ম্য। খাল দখল করে নির্মিত ভবনটি জাহাজের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে। তাই এটির নাম হয়ে গেছে জাহাজ বিল্ডিং।

এ ভবন সিলেট সিটি করপোরেশনের ২৫ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায়। সম্প্রতি সিটি করপোরেশন নগরের প্রবেশমুখের দক্ষিণ সুরমা এলাকায় বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে সাঁড়াশি অভিযান চালায়। এর মধ্যে ঠায় দাঁড়ানো ভবনটির দেখা মেলে। সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল দপ্তর কয়েক দফা ভবনটি ভাঙার নোটিশ দিয়েছে। কিন্তু মালিক প্রবাসী অজুহাত দেখিয়ে তত্ত্বাবধায়ক ভবনটি ভাঙার কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। এভাবে তিন দফা নোটিশের পর সর্বশেষ গত মঙ্গলবার সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নতুন পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি ভবনটির অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে দুদিন সময় বেঁধে দিয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার সেই সময় শেষ হয়েছে।

সময়সীমা পার হওয়ায় সিটি কর্তৃপক্ষ ভবনটি ভাঙার প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানিয়েছেন সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জাহাজ বিল্ডিংটি সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার আগে তৈরি হয়েছে। এখন হঠাৎ করে চোখে পড়েছে, এটি খাল দখল করে নির্মিত। তাই ভবনটি ভাঙার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। মালিকপক্ষ দুদিন সময় চেয়েছিল, তাদের সে সময় দেওয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে নিজেরা উদ্যোগী হয়ে ভবনটি না ভাঙলে সিটি করপোরেশন ব্যবস্থা নেবে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ২৫ নম্বর ওয়ার্ড এলাকা দিয়ে প্রবহমান জৈন্তারখাল দখলমুক্ত করেছে সিটি করপোরেশন। খাল পুনরুদ্ধার হওয়ায় জাহাজ বিল্ডিং যে পুরোটা খাল দখল করে তৈরি, সেটি এখন দৃশ্যমান হয়েছে। তিনতলা ভবন। দেখতে জাহাজ আকৃতির মতোই। তিন তলায় মোট ফ্ল্যাট ৩৫টি। সব কটি ভাড়া দেওয়া আছে।

ভবনটির মালিক যুক্তরাজ্যপ্রবাসী লতিফুর রহমান ও মুহিবুর রহমান নামের দুই ব্যক্তি। দেখভাল করছেন একজন তত্ত্বাবধায়ক। ভাড়ায় বসবাসকারীদের অধিকাংশই ভবনে আছেন। দু-তিনটি পরিবার নিজ থেকে অন্যত্র চলে গেছে। মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তত্ত্বাবধায়ক মাহফুজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে দুদিন সময় দেওয়ার বিষয়টি প্রবাসে থাকা মালিকদের জানানো হয়েছে। তবে মালিকেরা এ বিষয়ে আর কিছু না জানানোয় তিনি কিছু বলতে পারছেন না।

সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, সিলেট নগরের দক্ষিণ দিকে সুরমা নদী। উত্তর-পূর্বে চা-বাগান ও টিলা। টিলা থেকে প্রাকৃতিকভাবে আসা ৯টি ছড়া এবং ৩টি খাল নগরের বিভিন্ন মহল্লা ঘুরে সুরমায় গিয়ে মিশেছে। এগুলোই শহরকে জলাবদ্ধতামুক্ত রাখতে জলপ্রবাহের প্রাকৃতিক ধারা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রাকৃতিক জলপ্রবাহকে সচল করে জলাবদ্ধতামুক্ত সিলেট নগর গড়তে সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ২৩৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এটি সিলেট নগরে সবচেয়ে বড় অঙ্কের বরাদ্দ। এর মধ্যে ১৫০ কোটি টাকার কাজ চলতি অর্থবছরে শুরু হয়েছে। প্রকল্পকাজের সঙ্গে তৈরি করা হয় জবরদখলের তালিকাও। মোট ১১টি ধাপে তালিকা তৈরি করা হয়। তালিকা তৈরিতে ছড়া-খালের আয়তন নির্ধারণ করতে ১৯৫৬ সালের রেকর্ড অনুসরণ করা হয়। এতে নগরের কেন্দ্রস্থলের অর্ধশতাধিক মহল্লা দিয়ে প্রবহমান ছড়া ও খালের মধ্যে ২৬২ জনের দখল পাওয়া যায়। কিন্তু এ তালিকায় ‘জাহাজ বিল্ডিং’ ছিল না।

এ প্রসঙ্গে সিটি করপোরেশনের একজন প্রকৌশলী বলেন, জাহাজ বিল্ডিংটি ১৯৮০ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল। তখন ওই এলাকা ছিল ইউনিয়ন পরিষদের অধীন। এ জন্য ওই ভবনের কোনো তথ্য সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে সংরক্ষিত ছিল না।

স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাকবিরুল ইসলাম বলেন, জাহাজ বিল্ডিংয়ের একাংশ যে জৈন্তারখালের ওপর নির্মিত হয়েছে, বিষয়টি ধরা পড়েছে সিটি করপোরেশনের সাম্প্রতিক খাল খননকাজ শুরুর পর। জৈন্তারখালটি উদ্ধার ও খননকাজ শুরু হলে জাহাজ বিল্ডিংটি ভেঙে পড়ার আশঙ্কাও আছে। ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ। তাই উচ্ছেদ করা জরুরি।

গত সোমবার মেয়রসহ সিটি করপোরেশনের একটি দল সেখানে যায়। ওই দিন সর্বশেষ পর্যায়ের মাপজোখ করা হয়। এতে ভবনটির বড় অংশ জৈন্তারখালে পড়ার বিষয়টি নিশ্চিত হলে ভাঙার নির্দেশনা দেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। ভবনটির তত্ত্বাবধায়ক তখন মালিক প্রবাসী অজুহাত দেখিয়ে সময় চান। পরদিন মেয়র সেখানে গিয়ে দুদিন সময় দিয়েছেন।

মেয়র প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিজ থেকে ভাঙার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। নতুবা সিটি করপোরেশন ভাঙলে তার খরচও মালিকদের বহন করতে হবে। এ বিষয়টি জানিয়ে দুদিন সময় দেওয়া হয়েছিল। এ সময় পার হওয়ায় সিটি করপোরেশনের সামনে এখন ভাঙার প্রস্তুতি ছাড়া আর বিকল্প থাকল না।’