বৈশাখ রাঙাতে যত ব্যস্ততা

মাটির তৈরি খেলনায় শেষ মুহূর্তে রংতুলির আঁচড় দিচ্ছেন এক মৃৎশিল্পী। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার বাদলা গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
মাটির তৈরি খেলনায় শেষ মুহূর্তে রংতুলির আঁচড় দিচ্ছেন এক মৃৎশিল্পী। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার বাদলা গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

বাঙালির প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ। এ উৎসব ঘিরে বরিশালে চলছে নানা প্রস্তুতি। বিশেষ করে মৃৎশিল্পীদের ব্যস্ততা এতটাই বেড়েছে যে দিন-রাত তাঁরা চোখের পাতা এক করতে পারছেন না।

মৃৎশিল্পীরা বলছেন, বছরে এই একটা উৎসব ঘিরে তাঁদের অনেক আশা থাকে। এমনিতে সারা বছর মৃৎশিল্পের তেমন চাহিদা থাকে না। নববর্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে বৈশাখী মেলা বসে। এ মেলায় কেবল চাহিদা থাকে। তাই সারা বছর উৎসবটার অপেক্ষা করেন তাঁরা। সারা বছর মাটির তৈজসপত্র তৈরি করে কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করলেও মেলার জন্য তৈরি করছেন বাহারি সব মাটির খেলনা। জেলার গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, বাকেরগঞ্জ ও বাবুগঞ্জ উপজেলার পালবাড়িগুলোতে চলছে শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা।

শিল্পবোদ্ধারা বলছেন, বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক অনবদ্য রূপ মৃৎশিল্প। এর সঙ্গে একদিকে জড়িয়ে আছে জীবনের প্রয়োজন আর অন্যদিকে নান্দনিকতা ও চিত্রকলার বহিঃপ্রকাশ। যে কারণে এই শিল্প বাঙালির নিজস্ব শিল্প, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের অংশ। মৃৎশিল্পের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন শিল্পকর্ম টেরাকোটা।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশা ইউনিয়নের বাদলা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন ধরনের মাটির সামগ্রী তৈরিতে ব্যস্ত রয়েছেন কারিগরেরা। এর মধ্যে রয়েছে মাটির হাঁড়ি-পাতিল, রবিঠাকুর, কাজী নজরুল, বঙ্গবন্ধু, গণেশসহ বিভিন্নজনের প্রতিকৃতি। পুতুল, হাতি, ঘোড়া, নৌকা, টিয়া, সিংহ, দোয়েল, কচ্ছপ, মাছ, হাঁস, মুরগির ডিমও রয়েছে। এ ছাড়া নানা জাতের ফল, ফুল আর বাহারি মাটির ব্যাংক, প্লেট, মগ, গ্লাস, চায়ের কাপ, পিঠা তৈরির ছাঁচও তৈরি হচ্ছে সমানতালে। পয়লা বৈশাখ থেকে পুরো মাস চলবে এ ব্যবসা।

বাদলা গ্রামের অনিল চন্দ্র পাল বলেন, এখন আর মাটির জিনিসের তেমন কদর নেই। সারা বছর টানাপোড়েনে চলতে হয়। পূর্বপুরুষের পেশা তাই ইচ্ছে হলেও ছাড়তে পারেন না। বৈশাখ মাস এলে মেলায় মাটির তৈরি খেলনা ও সামগ্রীর চাহিদা থাকে। তাই এই সময়টায় ভালো আয় হয়।

আগৈলঝাড়ার উত্তর শিহিপাশা গ্রামের তরণী পাল বলেন, এ শিল্পের জন্য প্রয়োজন হয় পরিষ্কার এঁটেল মাটি। কিন্তু এখন মাটির অভাব। তার ওপরে রং ও শ্রমিকদের মজুরি এবং আনুষঙ্গিক ব্যয় অনেক বেড়েছে। সে অনুযায়ী উৎপাদিত পণ্যের দাম অতটা বাড়েনি। তারপরও পূর্বপুরুষেরা এ পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাই সেই ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। এসব মাটির খেলনা ৩০ থেকে ১৫০ টাকায় পর্যন্ত বিক্রি হয়।

মৃৎশিল্পীরা জানান, বাজারে এখন মাটির তৈরি পণ্যের কোনো কদর নেই। প্লাস্টিক পণ্যের ওপর মজেছে মানুষ। ঐতিহ্যের প্রতি মানুষের দৃষ্টি ক্রমেই কমে যাচ্ছে। বাকেরঞ্জের কলসকাঠি এলাকার মৃৎশিল্পী রূপক পাল ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘কুমাররা কীভাবে বেঁচে আছে, তারা তাদের পারিশ্রমিক অনুযায়ী ন্যায্যমূল্য পায় কি না এ খোঁজখবর কেউ রাখে না। সরকার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যদি এ পেশাকে বাঁচিয়ে রাখতে এখনই যথাযথ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেন, তাহলে একসময় মৃৎশিল্পের বিলুপ্তি ঘটবে।’

মৃৎশিল্পীদের জীবনমান নিয়ে কাজ করেন বরিশাল চারুকলার সংগঠক সুশান্ত ঘোষ। তিনি বলেন, সভ্যতার সঙ্গে মৃৎশিল্পের যোগসূত্র রয়েছে। সভ্যতার সূচনাপর্বে মানুষ মৃৎশিল্পের ধারাবাহিক উৎকর্ষের পরিচয় দিয়েছে। এই শিল্প যেমন মানুষের প্রয়োজন মিটিয়েছে, তেমনি নান্দনিকতার ছাপও রেখেছে। তিনি বলেন, ‘প্রাচীনকাল থেকেই বরিশালের মৃৎশিল্পীদের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল বিভিন্ন স্থানে। এ অঞ্চলের কলসকাঠি, মহেশপুর, গৈলা, বাউফলে এই শিল্পের বিকাশ হয়েছিল। কিন্তু সেই ঐতিহ্যকে আমরা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে ধরে রাখতে পারিনি। এখন সময় এসেছে ঐতিহ্যের স্বার্থেই মৃৎশিল্পের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনতে হবে।’