হত্যা মামলা হাইকোর্টে বিচারাধীন, বিস্ফোরক মামলা বিচারিক আদালতে

২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল। রমনা বটমূলে পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান চলছিল। সেখানে বোমা হামলায় ঘটনাস্থলেই সাতজন নিহত হন (ফাইল ছবি)
২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল। রমনা বটমূলে পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান চলছিল। সেখানে বোমা হামলায় ঘটনাস্থলেই সাতজন নিহত হন (ফাইল ছবি)

১৮ বছর আগে রমনা বটমূলে পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে জঙ্গি হামলায় নিহত হন ১০ জন। ভয়াবহ সেই হামলার বিচারপ্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়নি।

ভয়াবহ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে প্রায় পাঁচ বছর আগে আট জঙ্গির ফাঁসি আর ছয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। হত্যা মামলাটি এখন হাইকোর্টে বিচারাধীন। মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন (ডেথ রেফারেন্স) ও জেল আপিল শুনানির জন্য কার্যতালিকায় এসেছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আজ শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি আশা করছেন, রমনা বটমূল হামলার ঘটনায় করা হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও জেল আপিলের শুনানি শুরু হবে।

তবে রমনা বটমূলে হামলার ঘটনায় বিস্ফোরক আইনের মামলার বিচারকাজ এখনো শেষ হয়নি। আদালত সূত্র বলছে, গত এক বছরে জঙ্গি আসামিদের নয়বার আদালতে হাজির করা হয়। কিন্তু কোনো সাক্ষীকে আর আদালতে হাজির করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান সরকারি কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু প্রথম আলোকে বলেন, রমনা বটমূলের হামলার ঘটনার হত্যা মামলায় বিচারিক আদালত থেকে আট আসামির ফাঁসি হয়েছে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে আরও ছয়জনের। একই ঘটনায় বিস্ফোরক আইনের মামলাটি যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, সে ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে যা যা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা তিনি নেবেন।

২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল। রমনা বটমূলে পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান চলছিল। সেখানে সকাল আটটা পাঁচ মিনিটে একটি শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরিত হয়। এর ১০-১৫ মিনিট পর বিস্ফোরিত হয় আরেকটি বোমা। বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই নিরীহ সাত ব্যক্তি প্রাণ হারান। আর আহত হন ২০ থেকে ২৫ জন। পরে আহত ব্যক্তিদের মধ্যে আরও তিনজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

এ ঘটনায় পুলিশ রমনা থানায় পৃথক দুটি মামলা করে। বিস্ফোরক আইনের মামলাটি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এ বিচারাধীন। আর হত্যা মামলাটি বিচারপতি রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি এ এস এম আবদুল মবীনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে বিচারাধীন। সংশ্লিষ্ট আদালতের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, গত বৃহস্পতিবার রমনা বটমূলের মামলাটি কার্যতালিকায় ছিল। শিগগির শুনানি শুরু হবে।

রমনার হামলায় জড়িত ১৪ জঙ্গি

রমনা বটমূলে বোমা হামলার মামলায় হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজিবি) অন্যতম শীর্ষ নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ আট জঙ্গির ফাঁসির দণ্ড দেন বিচারিক আদালত। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন মুফতি হান্নান (অন্য একটি মামলায় ফাঁসি কার্যকর), মাওলানা আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মাওলানা আকবর হোসাইন ওরফে হেলাল উদ্দিন, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা তাজউদ্দিন (সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই) এবং হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম ওরফে ওস্তাদ জাহাঙ্গীর বদর৷ তাঁদের মধ্যে শেষ চারজন এখনো পলাতক।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ছয় জঙ্গি হলেন হাফেজ আবু তাহের, মাওলানা সাব্বির ওরফে আবদুল হান্নান, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, মাওলানা আবদুর রউফ ও শাহাদাত উল্লা ওরফে জুয়েল৷
দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ১৪ জঙ্গির মধ্যে শাহাদাত উল্লা ছাড়া অন্যরা সবাই নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হুজিবির শীর্ষস্থানীয় নেতা৷ শাহাদাত উল্লা হলেন বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে র‍্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত নারায়ণগঞ্জের যুবদল নেতা মোমিন উল্লা ডেভিডের ছোট ভাই৷

কেন এই হামলা
বিচারিক আদালত ১৪ আসামিকে দণ্ড দিয়ে রায়ে বলেছিলেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, আতঙ্ক সৃষ্টি করাসহ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে কলুষিত তথা সংস্কৃতির চর্চা বন্ধ করার জন্য বোমা হামলা করেছিলেন আসামিরা।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছিলেন, বাঙালি জাতির ঐতিহ্য পয়লা বৈশাখ বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ২০০১ সালে বোমা হামলায় নিহত ব্যক্তিরা সাধারণ মানুষ। এই অনুষ্ঠান কোনো নির্দিষ্ট দল-মত-গোষ্ঠী বা ধর্মের লোকজন ছিলেন না। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী, নারী-পুরুষ, ছোট-বড়নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার হাজার হাজার মানুষ ওই অনুষ্ঠানে সমবেত হয়েছিল। ওই দিন ভোরে ঘটনাস্থলে দুটি বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল এবং পরে রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে বিস্ফোরণ ঘটানো হয় বলে বিশেষজ্ঞ মতামত পাওয়া যায়। বোমা হামলাকারীদের লক্ষ্য কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ছিল না। আয়োজক সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট একটি অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।

১৮ বছরেও রমনা বটমূলে হামলা মামলার বিচারপ্রক্রিয়া শেষ না হওয়ার ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে প্রথমে কিছুদিন হইচই হয়, আলোচনা হয়, এরপর তা হারিয়ে যায়। বিচারিক আদালতে কয়েকজনের শাস্তি হয়েছে, এটুকু যা সান্ত্বনা। রাজনৈতিক পরিচয়ে সরকারি কৌঁসুলি নিয়োগ হয়ে থাকে। ভুক্তভোগীরা ভুগতেই থাকেন।