প্রতিরোধে স্লোগানে কাঁপাও নিপীড়কের ভিত

মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান হত্যার ঘটনাসহ নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী পথনাটক ‘রেফারি’ পরিবেশন নগরনাটের। গতকাল বিকেলে সিলেট নগরের কিনব্রিজ এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান হত্যার ঘটনাসহ নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী পথনাটক ‘রেফারি’ পরিবেশন নগরনাটের। গতকাল বিকেলে সিলেট নগরের কিনব্রিজ এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

নারী নিপীড়নবিরোধী পথনাটক রেফারি। ফেনীর সোনাগাজীতে পুড়িয়ে হত্যার শিকার মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহানের সঙ্গে নিপীড়নমূলক যা কিছু হয়েছে, তারই চিত্রায়ণ।

সিলেটে ‘নগরনাট’ নামের সাংস্কৃতিক সংগঠনের এই পরিবেশনার মধ্য দিয়ে গতকাল শনিবার বিকেলে ‘প্রতিরোধে স্লোগানে কাঁপাও নিপীড়কের ভিত’ আহ্বানের প্রতিবাদী কর্মসূচি হয়। নাটক, গান আর প্রতিবাদী কথায় গতকাল নগরের সুরমা নদীতীরের কিনব্রিজ এলাকার পুরোটা রূপ নিয়েছিল প্রতিবাদী এক উদ্যানে। পথচলতি লোকজনও এই প্রতিবাদী কর্মসূচিতে একাত্ম হন।

নগরনাটের নাটক ছাড়াও প্রতিবাদী কর্মসূচিতে একাত্ম হয় একাধিক সাংস্কৃতিক ও তরুণদের সংগঠন। নুসরাত জাহানের খুনি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে প্রতিকৃতি নিয়ে মিছিল ও প্রতিবাদ সভা হয়। ধর্ষণসহ সব ধরনের নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক লেখাসংবলিত প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অংশ নেন শতাধিক তরুণ।

প্রতিবাদী অবস্থান কর্মসূচি চলাকালে গণজাগরণ মঞ্চ সিলেটের মুখপাত্র দেবাশীষ দেবু, রাজীব রাসেল, শিশু সংগঠন ‘উষা’র প্রধান সংগঠক তামিস্রা তিথি, নগরনাট সভাপতি উজ্জল চক্রবর্তী, নাট্যকর্মী দেবোজ্যোতি দাস, প্রথম আলো বন্ধুসভা সিলেটের সভাপতি শাহ সিকান্দার প্রমুখ বক্তব্য দেন। রেফারি নাটকটির নির্দেশনা দেন নগরনাটের অরূপ বাউল।

বক্তারা বলেন, দেশে একের পর এক নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে নারী। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব ধর্ষণ-নিপীড়নের বিচার হয় না। ধর্ষকেরা ক্ষমতাবান হওয়ায় প্রশাসনও তাদের সহযোগিতা করে। নুসরাত হত্যার বিচার দাবির সঙ্গে কুমিল্লার সোহাগী জাহান তনু হত্যার বিষয়টিও আলোচনায় উঠে আসছে উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, আজ পর্যন্ত দেশের মানুষ জানতে পারেনি তনুকে কারা হত্যা করেছে। এমন বিচারহীনতা চলতে থাকায় নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলছে। যার সর্বশেষ শিকার মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত। নুসরাত হত্যাসহ সব নির্যাতনের ঘটনার বিচার দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে করার দাবি জানান বক্তারা।

বিচারের দাবিতে মৌলভীবাজারে প্রগতিশীল রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে মানববন্ধন। গতকাল বিকেলে মৌলভীবাজার প্রেসক্লাবের সামনে। ছবি: প্রথম আলো
বিচারের দাবিতে মৌলভীবাজারে প্রগতিশীল রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে মানববন্ধন। গতকাল বিকেলে মৌলভীবাজার প্রেসক্লাবের সামনে। ছবি: প্রথম আলো

কিনব্রিজ এলাকায় এ কর্মসূচি চলাকালে সিলেটের দর্পণ থিয়েটার প্রতিবাদী শোভাযাত্রা করে। যৌন নিপীড়নবিরোধী বিভিন্ন প্রতীকী প্রতিবাদ চিত্রসংবলিত শোভাযাত্রা নগরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে কিনব্রিজ এলাকায় গিয়ে শেষ হয়। নগরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও ‘হিউম্যান ওয়াচ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ’ নামের মানবাধিকার সংগঠন মানববন্ধন করে নুসরাত হত্যার দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছে। একই দাবিতে নগরের বাইরে সিলেটের গোলাপগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদরে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছেন।

মৌলভীবাজারে গতকাল বিকেলে প্রেসক্লাবের সামনে প্রগতিশীল রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের ব্যানারে মানববন্ধন হয়েছে। মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন বাসদের মৌলভীবাজার জেলা শাখার আহ্বায়ক মইনুর রহমান। সাংস্কৃতিক সংগঠক জহর লাল দত্তের সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দ আবু জাফর আহমদ, মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নিলিমেষ ঘোষ, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর জেলা শাখার সভাপতি মিজানুর রহমান, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ শাখার সভাপতি বিশ্বজিৎ নন্দী প্রমুখ। মানববন্ধনে সংহতি প্রকাশ করে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন।

কর্মসূচিতে বক্তারা বলেন, দেশে সুশাসন, আইনের শাসনের অভাবে খুনি, ধর্ষক, অন্যায়কারীরা আজ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। নারী ও শিশু নির্যাতন বেড়ে গেছে। শুধু পথঘাটেই না। ঘরে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোথাও কেউ নিরাপদ নেই। নিরীহ সাধারণ মানুষ ভয়ের মধ্যে আছে। সুবিচার পাবে না বলে নির্যাতিত অনেকেই আইনের আশ্রয়েও যাচ্ছে না। মানুষকে সুবিচার পাইয়ে দেওয়ার দায়। অভয় দেওয়ার দায় সরকারের। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সরকারকে কঠোর হাতে সব অন্যায়কে প্রতিরোধ করতে হবে। শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো পরিচয়েই কাউকে ছাড় দেওয়া যাবে না।

কুলাউড়া উপজেলার পৃথিমপাশা ইউনিয়নের ঝিলেরপাড় বাজারে গতকাল বিকেলে মানববন্ধন হয়েছে। ‘ঝিলেরপাড় ছাত্র-যুব-জনতা’র ব্যানারে এ কর্মসূচিতে স্থানীয় বাসিন্দা উপজেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ফয়জুল হকের সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন জাসদের উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল গাফফার, স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল আহাদ, সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীর দক্ষিণ লংলা কমিটির সভাপতি গিরিধারী দে, কলেজশিক্ষক জিসানুজ্জামান, স্কুলশিক্ষিকা দিপালী নাথ, ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের সভাপতি কবির উদ্দিন প্রমুখ।

শ্রীমঙ্গলে গতকাল মানববন্ধন করেছে বাংলাদেশ আনজুমানে তালামিজে ইসলামিয়ার উপজেলা শাখা। শহরের হবিগঞ্জ সড়কের আনোয়ারুল উলুম ফাজিল মাদ্রাসার সামনে এই কর্মসূচিতে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাহবুব আহমেদ সালেহ সভাপতিত্ব করেন। বক্তব্য দেন সংগঠনের উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর আলম, সহসভাপতি শামসুল ইসলাম, সাংগঠনিক সম্পাদক কামাল হোসেন, মাদ্রাসার শিক্ষক জুনায়েদ আহমেদ ও এনামুল হক প্রমুখ।

মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি, যৌন নির্যাতনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য কঠোর আইন করা হোক। যেন নারীদের নির্যাতন করতে তারা ভয় পায়।

সুনামগঞ্জে গতকাল সাধারণ শিক্ষার্থী, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিশ্বজন, সচেতন নাগরিক সমাজ ও হৃদয়ে শেখ মুজিব নামের চারটি সংগঠনের ব্যানারে মানববন্ধন হয়েছে। দিনের বিভিন্ন সময় পৌর শহরের আলফাত স্কয়ার এলাকায় এই কর্মসূচি পালিত হয়।

বেলা ১১টায় মানববন্ধন হয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে। বক্তব্য দেন সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের নবনির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান আবুল হাসেন, সংস্কৃতিকর্মী রবিউল ইসলাম, ছাত্রনেতা দ্বিপাল ভট্টাচার্য, নুরজাহান সাদেক প্রমুখ। দুপুরে অনুষ্ঠিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিশ্বজনের মানববন্ধনে বক্তব্য দেন চিকিৎসক সৈকত দাস, শিক্ষার্থী রাকিবুল ইসলাম, কর্নদাস প্রমুখ। বেলা তিনটায় সচেতন নাগরিক সমাজের ব্যানারে মানববন্ধনে বক্তব্য দেন জেলা উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম, ছাত্রনেতা দ্বিপাল ভট্টাচার্য, যুব মহিলা লীগের জেলা সভাপতি সানজিদা নাসরিন, সংস্কৃতিকর্মী পুলক রাজ, শিক্ষার্থী চাঁদনী আক্তার, সুকান্ত দত্ত প্রমুখ। বিকেল সাড়ে চারটায় ‘হৃদয়ে শেখ মুজিব’-এর মানববন্ধনে বক্তব্য দেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জুবের আহমদ, কবি শামস শামীম, রাজনৈতিক দলের কর্মী মখলিছুর রহমান, হিবলু আহমেদ চৌধুরী ও তাপস আহমদ প্রমুখ।

কর্মসূচিতে বক্তারা বলেন, নুসরাত জাহানকে যারা নিষ্ঠুরভাবে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, তাদের ফাঁসি দিতে হবে। এই মৃত্যু মানুষের বিবেককে জাগিয়ে দিয়েছে। এই মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। বাংলাদেশে এভাবে আর যেন কোনো নুসরাতের মৃত্যু না হয়। সমাজের সর্বস্তরে নারী-শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

[প্রতিবেদনের তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট, মৌলভীবাজার সুনামগঞ্জ এবং প্রতিনিধি, জুড়ীশ্রীমঙ্গল]