বাঘ ও সারসের সেই গল্পটা...

মঙ্গল শোভাযাত্রায় বাঘ ও সারসের অনুষঙ্গ। শোভাযাত্রার আগের ছবি। চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৪ এপ্রিল। ছবি: আবদুস সালাম
মঙ্গল শোভাযাত্রায় বাঘ ও সারসের অনুষঙ্গ। শোভাযাত্রার আগের ছবি। চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৪ এপ্রিল। ছবি: আবদুস সালাম

গল্পটা নিশ্চয় অনেকেরই জানা। বাঘ আর সারসের ওই গল্পটা? আরেকবার গল্পটা জানার আগে শুনি ‘উপলক্ষটা কী’। এবারের নববর্ষ উদ্‌যাপনের শোভাযাত্রার শিল্পকাঠামোগুলোর মূলটিতে বাঘের মুখ থেকে হাড় তোলার চিরায়ত গল্পটি উপস্থাপিত হয় বাঘ ও সারসের অনুষঙ্গে। রোববার সকালে চারুকলা থেকে বের হওয়ার শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দেয় এই শিল্পকাঠামো। পাশাপাশি আরও সাতটি বড় শিল্পকাঠামো ছিল। একেকটির গল্প বা উপলক্ষ একেক রকম।

এবার শুনি সেই গল্পটা। সংক্ষেপে। এক বাঘের গলায় হাড় ফুটেছিল। বাঘ অনেক চেষ্টা করেও হাড় বের করতে পারল না; যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে চারদিকে দৌড়ে বেড়াতে লাগল। সে যে জন্তুকে সামনে দেখে তাকেই বলে, ‘যদি তুমি আমার গলা থেকে হাড় বের করে দাও, তবে আমি তোমায় পুরস্কার দেব এবং চিরদিনের জন্য তোমার কেনা গোলাম হয়ে থাকব।’ কিন্তু যুক্তিসংগত কারণে বাঘের মিষ্টি কথায়ও কেউ ভোলে না। কোনো জন্তুই রাজি হলো না।
অবশেষে, এক সারস পাখি পুরস্কারের আশায় রাজি হলো। বাঘের মুখের ভেতর লম্বা ঠোঁট ঢুকিয়ে দিয়ে, অনেক যত্নে হাড়টি বের করে আনল। বাঘটা সুস্থ হলো। তবে সরল সারস পুরস্কারের কথা বলামাত্র, সে দাঁত কড়মড় ও চোখ লাল করে বলল, ‘আরে বোকা, তুই বাঘের মুখে ঠোঁট ঢুকিয়ে দিয়েছিলি। তোকে যে তখনই আমি খাইনি সেটাই তোর ভাগ্য, আবার পুরস্কার চাস!’ 
এ গল্পের বিষয় সহজ। নানাভাবে ব্যাখ্যাও করেন গল্পের কথক। তাহলে মঙ্গল শোভাযাত্রায় কী বলতে চাইছেন শিল্পীরা। কথা হলো চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, বাঁশ এবং কাগজের তৈরি এসব মুখোশ বা অন্যান্য মোটিফের একটা বৈশিষ্ট্য আছে, এগুলো তৈরি হয় কোনো একটা প্রতিপাদ্যের ওপর ভিত্তি করে। যেমন, এ বছর মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে, ‘মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে’। নিসার হোসেন বলেন, ‘এই শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয় দেশবাসীর মঙ্গল কামনা করে। আমরা জানি রাজধানীর জীবনে বাঙালি জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার তেমন সুযোগ থাকে না। আমরা মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে নগরবাসীকে বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করি। সেই ভাবনা থেকে এবারের শিল্পকাঠামোগুলো এসেছে। এর মধ্যে মূল কাঠামোতে গল্পটাই স্পষ্ট। কঠিন বিপদেও একজন দুর্বল বা যাকে শত্রু ভাবছি, সেও যে উপকারে আসতে পারে সেটি। এটিকে আবার আপনি অন্যভাবেও দেখতে পারেন। সমাজের ক্ষমতাসীনরা সাধারণকে ব্যবহার করে নিজেদের কার্যসিদ্ধি করে। একসময় আবার সাধারণকে ছুড়ে ফেলে।’
এগুলো তৈরিতে উচ্চ শিল্পমানসম্পন্ন নয় বরং একেবারেই সহজ লোকজ আঙ্গিক ব্যবহার করা হয়েছে। যেন সাধারণ মানুষ সহজেই বুঝতে পারে। বিদেশিরাও এ ধারা পছন্দ করে।
এবারের শোভাযাত্রায় পাখির প্রতিকৃতি বেশি ছিল। শোভাযাত্রায় সমৃদ্ধির কথা বলছে ছাগল আর সিংহের সমন্বয়ের বিশেষ মোটিফ। লোকজ ঐতিহ্যের চিত্র মেলে ধরে গাজির পটের গাছ। এ ছাড়া অনুষঙ্গের মধ্যে ছিল দুই মাথা ঘোড়া, দুই পাখি, কাঠঠোকরা, পঙ্খীরাজ ঘোড়া। মানুষের হাতে রংবেরঙের পাখা, সরাচিত্র, বাদুড়, টিয়াসহ নানা জাতের পাখি। নানা আকৃতির মুখোশও হাতে দেখা গেছে, কেননা মুখোশ মুখে রাখা বারণ ছিল। তবে নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে করা এ শোভাযাত্রায় সব সময়ই প্যাঁচার উপস্থিতি দেখা যায়। এই প্যাঁচা কৃষকের বন্ধু। তারা ইঁদুর খেয়ে কৃষকের ফসল রক্ষায় সাহায্য করে। এ প্রসঙ্গে নিসার হোসেন বলেন, বাংলাদেশের কৃষিজীবী মানুষদের একটি উৎসব হলো পয়লা বৈশাখ। তাঁদের এই উৎসবটি ঘিরে যেসব সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়েছে, সেটা আমরা মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে উপস্থাপন করি। পয়লা বৈশাখ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের লোকসংস্কৃতির উৎসব; এখানে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্ম নিয়ে টানাটানি করলে চলবে না।
বরাবরই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, অসাম্প্রদায়িক লোকচেতনাকে ধারণ করে আয়োজন করা হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রার। সময়ের বিবেচনায় প্রতিবছরই আলাদা থিম ঠিক করা হয়। শিল্পী নিসার হোসেন বলেন, ‘নতুন বছরের প্রথম দিনে আমাদের কামনাটা কী, সেটিই আমরা মঙ্গল শোভাযাত্রার ব্যানারে লিখি। আমরা চেষ্টা করি আমাদের দেশের কোনো মহান ব্যক্তি, কোনো সাহিত্যিক বা কোনো দার্শনিকের একটা বাণী শোভাযাত্রায় ব্যবহার করা। প্রথমে আমাদের ভাবনা ছিল এবারের থিমে ইতিবাচক কিছুই সামনে রাখা হবে এবার। আশার কথা, স্বপ্নের কথাই প্রধান হয়ে উঠবে। জীবনের জয়গান করব আমরা। পরে অনেকে ভেবে রবীন্দ্রনাথের “নৈবেদ্য” কাব্যগ্রন্থের ৪৮ নম্বর কবিতার “মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে” বাণীকে শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার পরও নানা ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। সে জন্যই এবারের শোভাযাত্রায় অনুপ্রেরণার উৎসব সন্ধান করা হয়।’