বিএনপি নেতা খুনের পেছনে পরিবহন ব্যবসা, দাবি স্ত্রীর

মাহবুব আলম শাহীন। ছবি: সংগৃহীত
মাহবুব আলম শাহীন। ছবি: সংগৃহীত

দোতলা বাসায় অনেক মানুষের ভিড়। সবার মুখ থমথমে। দুই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছেন নিহত বগুড়া সদর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক, আইনজীবী ও পরিবহন ব্যবসায়ী মাহবুব আলমের (শাহিন) স্ত্রী। অন্য স্বজনেরাও কাঁদছেন।

গতকাল বগুড়ায় জনাকীর্ণ বাজারে মাহবুব আলমকে ছুরিকাঘাতে খুন করে দুর্বৃত্তরা। সকাল সাতটায় তাঁর বাসায় গিয়ে দেখা যায় মাতম। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ তখনো বাসায় পৌঁছায়নি। মাহবুব আলমের স্ত্রী আকতার জাহান দাবি করেন, পরিবহন ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরেই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। বাসের ব্যবসা নিয়ে মালিক সংগঠনের একটি পক্ষের সঙ্গে বিরোধ ছিল তাঁর স্বামী মাহবুব আলমের। সেই বিরোধের জেরেই ভাড়াটে খুনি লেলিয়ে দিয়ে পূর্বপরিকল্পিতভাবে তাঁর স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে।

আকতার জাহান বলেন, বর্তমানে মাহবুবের মালিকানাধীন দুটি বড় বাস রয়েছে। এই বাস দুটি তুহিন পরিবহনের ব্যানারে রংপুর থেকে বরিশাল রুটে চলাচল করছিল। এরই মধ্যে বাসমালিক সংগঠন নিয়ে তাঁর স্বামীর সঙ্গে প্রভাবশালী একটি মহলের দ্বন্দ্ব বাধে। দ্বন্দ্বের জেরে বাস দুটি চলাচলে বাধা দেন মালিকেরা। পরে বাস দুটি আনন্দ পরিবহনের ব্যানারে বগুড়া-সিলেট রুটে চলাচল করছিল। গতকাল রাত নয়টার দিকে সেই বাসও বগুড়ার শেরপুরে আটকে দেওয়া হয়। তিনি দাবি করেন, ক্ষমতাসীন দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা প্রভাবশালী বাসমালিকেরা তাঁর স্বামীকে বেশ কিছুদিন ধরেই হুমকি দিয়ে আসছিলেন। ভাড়াটে খুনি লেলিয়ে দিয়ে তাঁর স্বামীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তিনি প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করবেন।

এদিকে মাহবুব আলম খুনের ঘটনা তদন্তে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডলকে প্রধান করে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির অন্যরা হলেন সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সনাতন চক্রবর্তী, জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিদর্শক নূরে এ আলম সিদ্দিকী, সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম বদিউজ্জামান, ডিবির পরিদর্শক আছলাম আলী, উপশহর পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক শফিকুল ইসলাম এবং ফুলবাড়ি পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক আমবার আলী।

আজ সোমবার দুপুরে বগুড়ার পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা প্রথম আলোকে বলেন, ‘কমিটিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে খুনের রহস্য উদ্‌ঘাটন এবং খুনিদের চিহ্নিত ও গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় দুপুর পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। তবে পুলিশ বসে নেই। খুনের রহস্য উদ্‌ঘাটন এবং খুনিদের ধরতে পুলিশের একাধিক দল মাঠে নেমেছে।’

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সনাতন চক্রবর্তী বলেন, ইতিমধ্যেই ঘটনাস্থলের সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। এতে নিশ্চিত হওয়া গেছে, হত্যাকাণ্ডে ৬ থেকে ৭ জন দুর্বৃত্ত অংশ নেয়। খুনিদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, উপশহর বাজারে ১০ তলা বিল্ডিংয়ের সামনে মাহবুব আলম মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। আকস্মিকভাবে পাঁচ থেকে ছয়জন দুর্বৃত্ত তাঁকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে দ্রুত সটকে পড়ে। স্থানীয় ব্যক্তিরা মাহবুবকে উদ্ধার করে প্রথম একটি ক্লিনিকে এবং পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

এই হামলার সময় মাহবুব আলমের সঙ্গে ছিলেন বগুড়া সদর উপজেলার নুনগোলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আলিমুদ্দীন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা একসঙ্গে বাজারে গল্প করছিলেন। এরই মধ্যে মাহবুবের ফোনে একটি কল আসে। তিনি কল রিসিভ করে কথা বলতে বলতে প্রায় পাঁচ ফুট দূরে সরে যান। এ সময় পাঁচ থেকে ছয়জন দুর্বৃত্ত মাহবুবের ওপর হামলা করে। মুহূর্তের মধ্যে তাঁকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে দুই থেকে তিনজন একটি মোটরসাইকেলে করে এবং অন্যরা দ্রুত হেঁটে পালিয়ে যায়।

বিএনপির প্রতিবাদ কর্মসূচি

মাহবুব আলমকে হত্যা করা হয়েছে শুনে গতকাল রাতেই জেলা বিএনপির সভাপতি-সম্পাদকসহ শীর্ষ নেতারা হাসপাতালে ছুটে যান। পরে আজ বেলা ১১টায় শহরের নওয়াববাড়ি সড়কে দলীয় কার্যালয়ে জেলা বিএনপির জরুরি বৈঠকে প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়। জানাজা শেষে দলের পক্ষ থেকে কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়া হবে।

আইনজীবীদের প্রতিবাদ

মাহবুব আলম হত্যার প্রতিবাদে বগুড়া জেলা আদালতের সর্বদলীয় আইনজীবীরা শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। আজ বেলা আড়াইটায় জেলা আইনজীবী সমিতির উদ্যোগে বের হওয়া বিক্ষোভ মিছিল শেষে জেলা জজ আদালতের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে মাহবুব আলমের খুনিদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।