রাত ১২টায় না ভোরে?

মঙ্গল শোভাযাত্রা । প্রথম আলো ফাইল ছবি
মঙ্গল শোভাযাত্রা । প্রথম আলো ফাইল ছবি

১৩ এপ্রিল রাত ১২টা বাজতেই মুঠোফোনে বার্তা আসতে লাগল, ‘শুভ নববর্ষ’। আবার সকালে ঘুম থেকে উঠে মুঠোফোন আর অনলাইনের ইনবক্সে বার্তার পর বার্তা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় সারা দিন ছিল তর্ক-কথার তুবড়ি। কেউ বলছে বাংলা নববর্ষ শুরু হবে ভোরে। আবার কেউ কিছু বলছে না। কিন্তু রাত হতেই বার্তা পাঠাচ্ছেন। মনের কোণে উঁকি দিল, নববর্ষের শুরুটা কখন—রাত ১২টায়, নাকি ভোর–সকালে?

কিন্তু ছুটির দিনে এই তথ্য পাই কোথায়? এর উত্তর খুঁজতে হলে তো যেতে হবে বাংলা একাডেমিতে। কারণ, বাংলা বর্ষপঞ্জির অভিভাবক এই প্রতিষ্ঠান। পয়লা বৈশাখ বলে তো সেই একাডেমিও বন্ধ। অনেকক্ষণ বসে ভাবলাম কী করি। কম্পিউটারের ইউটিউবে গিয়ে সার্চ দিলাম পয়লা বৈশাখের জনপ্রিয় গান ‘মেলায় যাইরে’। গান চলছে। চট করে মাথায় এল, ‘আরে, বাংলা একাডেমি বন্ধ, কিন্তু তাদের ওয়েবসাইট তো আর বন্ধ না!’

কম্পিউটার কি–বোর্ডে তথ্য খোঁজার সাইট গুগলে টাইপ করতেই চলে এল নানা তথ্য। উইকিপিডিয়া বলছে, পয়লা বৈশাখ রাত ১২টা থেকে শুরু না সূর্যোদয় থেকে শুরু, এ নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে সূর্যোদয় থেকে বাংলা দিনগণনার রীতি থাকলেও ১৪০২ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ (১৯৯৫ সাল) থেকে বাংলা একাডেমি এই নিয়ম বাতিল করে আন্তর্জাতিক রীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে রাত ১২টায় দিনগণনা শুরুর নিয়ম চালু করে।

বাহ, উইকিপিডিয়ার থেকে তো একটা ধারণা মিলল। কিন্তু এ তো পুরোপুরি আমলে নেওয়া যাবে না। তথ্য ক্রসচেক করতে হবে। কারণ, উইকিপিডিয়ার তথ্য যেকেউ সম্পাদনা করতে পারে। উইকির তথ্য ধরে কিছু লিখতে হলে যদি ভুল হয়। আজকাল পাঠক তো বেজায় সচেতন, সচেতন অনলাইনের বন্ধুরাও। দুম করে অনলাইনে লিখে দিলাম আর আনাড়ি তথ্য ছড়িয়ে গেল। দায়িত্বশীল পরিচয় একেবারে মাঠে মারা যাবে যে!

ফেসবুকে ঢুঁ মারতেই দেখলাম, রাশেদুল ইসলাম নামের একজন স্ট্যাটাস দিয়েছেন, ‘বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে হবে ভোরে বা সকালে।’ হাসান জেমস নামের এক বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘বাংলা দিন বা নববর্ষ শুরু হয় সূর্যোদয়ে, রাত ১২টায় না।’ কমেন্ট সেকশনে উঁকি মেরে দেখি, ওরে বাবা, নানা তর্ক চলছে সেখানে।

অগত্যা বাংলা একাডেমির ওয়েবসাইট থেকে জানলাম, বাংলা পঞ্জিকাকে বিজ্ঞানভিত্তিক করার জন্য তিনবার সংস্কার করা হয়েছে। ১৯৯৫ সালের ২৬ জুলাই একাডেমি একটি টাস্কফোর্স গঠন করে। সে টাস্কফোর্স সুপারিশসহ সিদ্ধান্ত দেয়, ‘গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির অধিবর্ষ যে বাংলা বছরের ফাল্গুন মাস পড়বে, সেই বাংলা বছরকে অধিবর্ষরূপে গণ্য করা হবে; ১৪০২ সালের ১ বৈশাখ থেকে এটি কার্যকর হবে এবং তারিখ পরিবর্তনের সময় হবে আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী রাত ১২টায়।’

বাংলা বর্ষপঞ্জি তৃতীয় দফায় সংস্কার হয় ২০১৭ সালে (বাংলা ১৪২৪ সন)। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের (ইংরেজি ক্যালেন্ডার) সঙ্গে বাংলা বর্ষপঞ্জির বিশেষ দিনগুলোর বিভিন্ন ব্যত্যয় দূর করে তা আরও বিজ্ঞানভিত্তিক করা হয়। এর মানে হলো, ১৯৯৫ সাল থেকে যদি আপনি রাত ১২টায় কাউকে শুভেচ্ছা জানিয়ে থাকেন, তা কোনোভাবেই ভুল হবে না। কৌশলগতভাবে এটা মোটেও ভুল নয়।

বাংলা নববর্ষ রাতে শুরু হয়—এমন বক্তব্যে দ্বিমত পোষণ করলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উদয় শঙ্কর বিশ্বাস। মুঠোফোনে তিনি বললেন, ‘আমরা বাঙালিরা ঐতিহ্যগতভাবে যেসব অনুষ্ঠান পালন করি, তার সবই শুরু হয় দিনের শুরুতে। তবে চড়কপূজা, মুখানৃত্য, হাজরানৃত্য—এসব অনুষ্ঠান রাতে শুরু হয়। এ ছাড়া সবই দিনের আলোয় হয়। কিন্তু ইংরেজি তারিখে দিন শুরু হয় রাত ১২টায়। তাই ইংরেজরা শুভেচ্ছা জানায় রাতে। আমাদের দেশের শহুরে মানুষদের মধ্যে একটা চল শুরু হয়েছে রাতে শুভেচ্ছা জানানোর। কৌশলগতভাবে এটা ভুল নয়।’

উদয় শঙ্কর বিশ্বাস আরও বলেন, দিন তো শুরু হয় ভোরের আলো ফুটলে। শহুরে মানুষেরা এই চল শুরু করেছে। কিন্তু গ্রামের মানুষের সকালেই দিন শুরু হয়। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত মানে একটা দিন। ঘুমন্ত অবস্থায় তো মানুষ দিন শুরু করতে পারে না।

এত তথ্য-কথা-মতের হেতু, তাহলে আমরা কী করব? আমার মতে, আপনি যদি ঐতিহ্য লালন ও অনুসরণ করতে চান, তাহলে ভোরে, সকালে বা দিনের যেকোনো সময় বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানান। আর আপনি যদি সংস্কার হওয়া পঞ্জিকা কাঁটায় কাঁটায় অনুসরণ করেন, তাহলে রাতেও শুভেচ্ছা জানাতে পারেন। শুভেচ্ছা তো শুভেচ্ছাই। এর রাত আর দিনের পার্থক্য হলে ক্ষতি কী?