কিছুই পায়নি রাজীবের পরিবার

দুই বাসের ফাঁকে আটকে পড়া কলেজছাত্র রাজীবের সেই ছিন্ন হাত। গত বছরের ৩ এপ্রিল রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারার মোড়ে।  ফাইল ছবি
দুই বাসের ফাঁকে আটকে পড়া কলেজছাত্র রাজীবের সেই ছিন্ন হাত। গত বছরের ৩ এপ্রিল রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারার মোড়ে। ফাইল ছবি
>

• রাজীবের মৃত্যুর এক বছর
• দুই চালকের বিরুদ্ধে বেপরোয়া বাস চালিয়ে প্রাণহানির প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ
• ক্ষতিপূরণের রিটের চূড়ান্ত শুনানি ১৭ এপ্রিল


দুই বাসের মধ্যে ঝুলে থাকা কলেজছাত্র রাজীব হোসেনের (২১) কাটা হাতটা নাড়া দিয়েছিল বহু মানুষকে। তখন দেশের অনিরাপদ সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। আর রাজীব ১৩ দিন হাসপাতালে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরে যান। তাঁর মৃত্যুর পর নানা জনে নানা আশ্বাস দিয়েছিলেন, ক্ষতিপূরণের কথাও উঠেছিল। কিন্তু ঘটনার এক বছর পরে রাজীবের স্বজনেরা বলছেন, কোনো আশ্বাসই পূরণ হয়নি, কেউ কথা রাখেনি। আজ ১৬ এপ্রিল রাজীবের মৃত্যুর এক বছর পূর্ণ হচ্ছে।

গত বছরের ৩ এপ্রিল বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) একটি দোতলা বাসের পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলেন মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাজীব। পেছন থেকে স্বজন পরিবহনের একটি বাস বিআরটিসির বাসটির গায়ে ঘষা দিয়ে পেরিয়ে যায়। দুই বাসের প্রবল চাপে রাজীবের হাত কনুইয়ের ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাঁর মাথার সামনের-পেছনের হাড় ভেঙে যাওয়া ছাড়াও মস্তিষ্কে আঘাত লাগে। ১৬ এপ্রিল দিবাগত রাত পৌনে একটার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রাজীব।

রাজীবের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে শাহবাগ থানায় মামলা হয়, রাজীবের মৃত্যুর পরে মামলায় ‘অপরাধজনক প্রাণহানি’র অভিযোগ যুক্ত করা হয়। কিন্তু এক বছরেও পুলিশ সে মামলার তদন্ত শেষ করতে পারেনি। বিআরটিসি বাসের চালক ওয়াহিদ আলী এবং স্বজন পরিবহনের চালক মো. খোরশেদকে গত বছরই গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর গত এক বছরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদলেছে এক দফা, কিন্তু অভিযোগপত্র আর আদালতে জমা পড়েনি। নতুন তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ইদ্রিস আলী গত শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, দুই বাসের চালকের বিরুদ্ধে বেপরোয়া বাস চালিয়ে অপরাধজনক প্রাণহানির অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে চলতি মাসে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। তিনি বলেন, দুই বাসের চালক কারাগারে আছেন। জব্দ করা বাস দুটি শাহবাগ থানার পেছনের ডাম্পিংয়ে রাখা আছে।

রাজীবের মৃত্যুর ঘটনার জন্য হাইকোর্ট রাজীবের দুই ভাইকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনকে। দুই বাস কর্তৃপক্ষ আপিল করলে উচ্চ আদালত মৃত্যুর কারণ নিরূপণে তদন্ত কমিটি গঠন করতে বলেন। বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক মিজানুর রহমানকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। হাইকোর্টে জমা দেওয়া কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্ঘটনার জন্য স্বজন পরিবহনের বেপরোয়া চালনাই দায়ী। হালকা যানের চালককে দিয়ে ডাবল ডেকার চালানোর জন্য বিআরটিসিরও দায় রয়েছে।

ওই কমিটির সদস্য নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের ১৫ অক্টোবর তদন্ত কমিটি স্বজন পরিবহনকে দায়ী করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিআরটিসির দোতলা বাসটিরও কিছুটা দায় রয়েছে। রাজীবকে চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে শমরিতা হাসপাতালের গাফিলতি ছিল।

রাজীব হোসেন
রাজীব হোসেন

গত ৩ এপ্রিল রাজীবের আহত হওয়ার এক বছর পূর্তির দিনে ক্ষতিপূরণ দাবি করে হাইকোর্টে রিট করেন আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল। তিনি রুল শুনানির জন্য হাইকোর্টে মৌখিক আবেদন করেন। তাঁর আবেদনের ভিত্তিতে ১০ এপ্রিল বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানি হয়।

আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস গত শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, গত ১০ এপ্রিল রিটের আংশিক শুনানি হয়েছে। আগামী বুধবার (১৭ এপ্রিল) চূড়ান্ত শুনানি হবে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশমতো রাজীবের মৃত্যুর কারণ নিরূপণে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা পড়েছে আদালতে। তিনি আশা করছেন, কমিটির প্রতিবেদনের সাপেক্ষের রাজীবের এতিম দুই ভাই ক্ষতিপূরণ পাবে।

কেউ কথা রাখেনি
পটুয়াখালীর বাউফলের ছেলে রাজীব যখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তেন, তখনই মারা যান তাঁর মা। বাবা শোকে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন। রাজীব যখন অষ্টম শ্রেণিতে, তখন বাবারও মৃত্যু হয়। রাজীব ও তাঁর ছোট দুই ভাই পটুয়াখালীর বাউফলে নানার বাড়িতে আশ্রয় পান। পরে ঢাকায় এসে স্কুলে ভর্তি হন। খালার বাড়ি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর যাত্রাবাড়ীতে মেসে ওঠেন। নিজের পায়ে দাঁড়াতে কম্পিউটার, গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ শেখেন। ছাত্রও পড়াতেন। লক্ষ্য ছিল নিজের পায়ে দাঁড়ানো, ভাই দুটির দায়িত্ব নেওয়া। ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে মেজ খালা খাদিজা বেগম আর মতিঝিলে বড় খালা জাহানারা বেগমের বাসায় থেকে, কঠোর পরিশ্রমে স্নাতক পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন রাজীব। তিতুমীর কলেজে পড়াশোনার ফাঁকে একটি কম্পিউটারের দোকানে কাজ করে আর আত্মীয়স্বজনের সহায়তায় নিজের পাশাপাশি ছোট দুই ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ চালাচ্ছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুতে কিশোর বয়সী দুই ভাই পড়েছে গভীর অনিশ্চয়তায়।

গত বৃহস্পতিবার কথা হয় রাজীবের বড় খালা জাহানারা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রাজীবের জানাজায় দাঁড়িয়ে অনেকেই অনেক কথা দিয়েছিলেন। কেউ বলেছিলেন রাজীবের নামে রাস্তা হবে, কেউ টিউবওয়েল দিতে চেয়েছিলেন, কেউ রাজীবের নামে মাদ্রাসা করে তাঁর কবরের জায়গাটা পাকা করে দেওয়ার কথাও বলেছিলেন। কিন্তু কেউই কোনো কথা রাখেননি। সেই গাড়িচালকেরও শাস্তি হয়নি। এখন রাজীবের দুই এতিম ভাইয়ের থাকার জায়গাটুকুও নেই। মাদ্রাসা ছুটি হলে তারা অন্যের বাড়িতে গিয়ে ওঠে।