ডেইরি খাতে বিদেশি বিনিয়োগ দরকার

‘স্থানীয় ডেইরি খাত উন্নয়নের মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে পুষ্টিমান নিশ্চিতকরণ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা। আরলা ফুডস বাংলাদেশ লিমিটেডের সহযোগিতায় এই বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো। কারওয়ান বাজার, ঢাকা, ১৭ এপ্রিল। ছবি: হাসান রাজা
‘স্থানীয় ডেইরি খাত উন্নয়নের মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে পুষ্টিমান নিশ্চিতকরণ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা। আরলা ফুডস বাংলাদেশ লিমিটেডের সহযোগিতায় এই বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো। কারওয়ান বাজার, ঢাকা, ১৭ এপ্রিল। ছবি: হাসান রাজা

ডেইরি খাতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা আছে। তবে এই খাতে স্থানীয় খামারগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগ দরকার। এই খাতকে আরও এগিয়ে নিতে বিদেশি দুগ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর জ্ঞান ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় দেশীয় খামারিরা আরও সমৃদ্ধ হবেন। পাশাপাশি ভোক্তাদের খাদ্যাভ্যাসে নিয়মিত দুধ পানে সচেতন করতে হবে। তাতে মানুষের পুষ্টি নিশ্চিতের পাশাপাশি খামারিদের বাজারও সম্প্রসারণ হবে।

আজ বুধবার সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘স্থানীয় ডেইরি খাত উন্নয়নের মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে পুষ্টিমান নিশ্চিতকরণ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে কূটনীতিক, নীতিনির্ধারকসহ আলোচকেরা এসব কথা বলেন। আরলা ফুডস বাংলাদেশ লিমিটেডের সহযোগিতায় এই বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো।
বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
বৈঠকে বাংলাদেশে নিযুক্ত ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত উইনি এস্ট্রাপ পিটারসেন বলেন, বাংলাদেশ ও ডেনমার্কের অংশীদারত্ব অনেক আগে থেকে। গত বছর এই দুই দেশ একটি চুক্তি করেছে ডেইরি খাতে কাজ করার লক্ষ্যে। তবে এই খাতে অনেক সম্ভাবনার জায়গা ও কাজ করার সুযোগ বাকি আছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন বলেন, দেশের খামারিদের বাঁচাতে প্রত্যেকের খাদ্যাভ্যাসে নিয়মিত দুধ পান আনতে হবে। অভ্যাসটা বাড়াতে হবে। তাতে পুষ্টি নিশ্চিত হবে আবার খামারিরাও বাঁচবেন। আমদানি করা পশুখাদ্যের শুল্ক কমলে এর দামও কমে আসবে। তাতে দুধের দামও কমে আসবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক বলেন, ‘দুধের গুণগত উৎপাদন বাড়াতে হবে। অনেক নারী ও যুবক উদ্যোক্তা হিসেবে দুধের ন্যায্য দাম পান না। কারণ, উৎপাদক পর্যায়ে দুধের দাম খুব কম। বেশিটা ভোগ করে মধ্যস্বত্বভোগীরা। এসব সমস্যা সমাধান করে উৎপাদকেরা যাতে ভালো দাম পান, তা নিশ্চিত করতে হবে। তবে দুধ উৎপাদন থেকে বড় সমস্যা দুধ খাওয়ার অভ্যাস নেই বললেই চলে। আগে অভ্যাস তৈরি করতে হবে। আর এসব ক্ষেত্রে প্রচার চালাতে হবে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশ থেকে দুধ না এনে যদি দেশের স্থানীয় খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে, দুধ বাজারজাত করে, তাহলে দেশীয় খামারিরা আরও উৎসাহিত হবেন। প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং নলেজ শেয়ারিংয়ে খামারিরা অনেক উপকৃত হবেন। এটাই আমাদের চ্যালেঞ্জ।’

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক নাথুরাম সরকার বলেন, দেশীয় ডেইরি খাতকে সমৃদ্ধ করতে বহির্বিশ্বের উন্নত জাতের গরু এনে দেশীয় পদ্ধতিতে লালন-পালন করা যেতে পারে। জেনেটিক্যালি বেশি দুধ দেয় এমন গরুর জাত উদ্ভাবনে প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট কাজ করছে। তবে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ বিপণনের দিকটা। দুধ উৎপাদনের পর তার ন্যায্য দাম ঠিক করে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাতে হবে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘আমাদের যত পরিমাণ দুধ প্রতিদিন খাওয়া দরকার, সেই পরিমাণে খাওয়া হয় না। এই ঘাটতি বাড়ানো যায় আমদানি করে বা উৎপাদন বাড়িয়ে। তবে দুধে আমদানি শুল্ক হ্রাস করা হলে দীর্ঘমেয়াদি ভোক্তার অনুকূল হবে না বলে আমি মনে করি। কৃষকেরা উৎপাদন বাড়ালে দুধের দাম কমে আসবে। উৎপাদন বাড়াতে উন্নত মানের গরু খামারে ব্যবহার করতে হবে। গরুর খাবারের দাম কমানো, ফিড আমদানিতে ভ্যাট বা ট্যাক্সমুক্ত হওয়া উচিত। দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সরকারের উদ্যোগ প্রয়োজন।’
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মঞ্জুর মোরশেদ আহমেদ বলেন, ‘গত কয়েক মাসে গণমাধ্যমে খবর আসছে, দুধে সহনীয় মাত্রার চেয়ে অ্যান্টিবায়োটিক ও ভারী ধাতুর উপস্থিতি নিয়ে। আমাদের নিরাপদ দুধ উৎপাদন নিশ্চিত করে উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং এতে পুষ্টিও নিশ্চিত হবে। পশু পরিচর্যা বা যত্নের সময় অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হচ্ছে কি না, নজর দিতে হবে।’
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পশুপুষ্টি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক খান মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ক্ষুদ্র কৃষকদের টিকিয়ে রাখতে হলে তাঁদের উন্নতজাতের গরু দিতে হবে। শুধু উন্নত গরু বা গরু পালনপদ্ধতি দিলেই চলবে না, উৎপাদিত দুধ বিক্রির জায়গাও তৈরি করে দিতে হবে। যদি বিদেশ থেকে পাউডার গরুর দুধ আমদানি করা হয়, তাহলে সেটাও কীভাবে উৎপাদন হচ্ছে, তা নজরদারি করতে হবে। ভোক্তাকেও প্রতিদিন দুধ খাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে।
বাকৃবির ডেইরি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আশিকুল ইসলাম বলেন, দেশের দুগ্ধপশুগুলোর জেনেটিক মেরিট বা সুষম খাবার দেওয়ার ব্যাপারে ঘাটতি আছে। বিদেশ থেকে তৈরীকৃত দুগ্ধজাত পণ্য না এনে স্থানীয় কৃষকদের প্রযুক্তিগত সহায়তা দিলে তাঁরা আরও উৎপাদন বাড়াতে পারবেন। পরে কৃষকদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্য তৈরি করলেই দেশের এই খাতে টেকসই উন্নয়ন হবে। দেশের মানুষ তো দুধ না কিনে সেই টাকা দিয়ে এনার্জি ড্রিংক খায়। দুটোতেই একই পরিমাণ টাকা খরচ হয়।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রাণিসম্পদ বিভাগের পরিচালক এ বি এম খালেদুজ্জামান বলেন, সারা দেশে ৫৮ হাজার খামার আছে। এগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হয়। এসব খামারে ৭০ ভাগ খরচ হয় পশুখাদ্য জোগাড় করতে গিয়ে। পশুখাদ্যের খরচ কমাতে হবে। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শুল্কমুক্ত গো খাদ্য আমদানির ব্যাপারে সরকার কাজ করছে। পশুখাদ্যের দাম কমে এলে দুধের দামও কমে আসবে।
মিল্ক প্রডিউসারস কো-অপারেটিভ ইউনিয়ন লিমিটেডের অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশের ডেইরি খাতে মিল্ক ভিটা সবচেয়ে বড় সমবায় প্রতিষ্ঠান। যদি ঢাকার জনগোষ্ঠী দিনে ১ কাপ করে দুধ খায়, তাহলে প্রায় ১০ লাখ লিটার দুধ প্রতিদিন প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকা, চট্টগ্রাম শহরে দিনে ৫ লাখ লিটার দুধও বিক্রি হয় না। প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসে আমাদের অন্তত ১ কাপ দুধ খাওয়া উচিত। কারণ, প্রাণিজ আমিষ হিসেবে দুধের কোনো বিকল্প নেই। এটি খর্বাকৃতি রোধ করে এবং দৈনিক পুষ্টি নিশ্চিত করে। মানুষের মাঝে দুধের চাহিদা বাড়লে পুষ্টি নিশ্চিত হবেই।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজিব-উল-আলম বলেন, ‘গুঁড়াদুধ আমদানিতে উচ্চহারের সম্পূরক শুল্ক (সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি) আছে। দুধকে বিলাসী পণ্য হিসেবে বিবেচনা করে নানা নীতি দিয়ে এটিকে আমদানি করতে নিরুৎসাহিত করা হয়। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সমৃদ্ধি এবং ঘাটতি পূরণের জন্য দুধ আমদানি করা জরুরি হলেও দুধের ওপর শুল্ক তুলে নিলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন খামারি ও কৃষকেরা। টেকসই উন্নয়ন করতে হলে বড় ধরনের এই ফাঁকের সমন্বয় করতে হবে। আমরা চাই, বাংলাদেশ দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। এর জন্য বিদেশি বিনিয়োগ ও প্রযুক্তির হস্তান্তরের কোনো বিকল্প নেই।’
বাংলাদেশ ডেইরি ফারমারস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মো. শাহ এমরান বলেন, ‘বিগত পাঁচ বছরে ডেইরি খাতে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। তবে আমাদের আরও ভালো প্রযুক্তি, উন্নতমানের পশু দরকার।’
সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় দুগ্ধ উন্নয়ন ফোরামের সভাপতি উম্মে কুলসুম বলেন, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য (এসডিজি) নিশ্চিত করতে পুষ্টিমানের বিষয়টি আসে। আর পুষ্টি নিশ্চিতে দুধ একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য। তাই বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভাবতে হবে কীভাবে দেশের স্থানীয় খামারিদের প্রশিক্ষণ বা প্রযুক্তিগত সহযোগিতা করা যায়। কোনোভাবেই বিদেশ থেকে দুধ আমদানি কাম্য নয়। তাতে দেশের খামারিরা নিরুৎসাহিত হবেন। যেহেতু দেশের খামারিদের বেশির ভাগ নারী ও যুবক, তাই তাঁদের ক্ষতি করে কোনো উদ্যোগ নেওয়া যাবে না।
আরলা ফুডসের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্ক বুট বলেন, ‘বাংলাদেশে খর্বাকৃতি, অপুষ্টি একটি বড় ইস্যু। পশুখামার নিয়ে আমাদের যে জ্ঞান আছে, যা কিনা আমরা এই দেশের খামারিদের সঙ্গে বিনিময় করতে পারি। প্রযুক্তিগত সহায়তা ও সহযোগিতা হাতে-কলমে করতে হবে। বাংলাদেশেরও ডেইরি খাতে মুক্তবাজার অর্থনীতির নীতি নিতে হবে, যাতে করে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো এখানে বিনিয়োগ করতে পারে। যখন সুযোগ তৈরি হবে, তখন প্রতিষ্ঠানগুলো এ দেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে।’
আরলা বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পিটার হলবার্গ বলেন, ‘বাংলাদেশের ডেইরি খাতে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। এর মধ্যে কম উৎপাদন, দুধের দাম, মানসম্পন্ন দুধ এবং বাজারে দুধের সহজলভ্যতা অন্যতম। ডেইরি খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে এবং উন্নয়নে বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ অন্যতম চাবিকাঠি।’