আবেদন-বিক্ষোভের পরও বন্ধ হয়নি তামাক কারখানা

লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার তুষভান্ডার ইউনিয়নের তালুক বানীনগর গ্রামে আবাসিক এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে তামাক গুঁড়া করার কারখানা। এ কারখানার কারণে নানা ধরনের অসুখে পড়ছেন সংলগ্ন বাসিন্দারা। প্রশাসনের কাছে আবেদন এবং নানা বিক্ষোভ কর্মসূচির পরও বন্ধ করা হয়নি ওই কারখানা।

তালুক বানীনগর গ্রামে প্রায় চার শ পরিবারের বাস। রয়েছে হাট-বাজার ও শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই তামাক গুঁড়া করার কারখানার কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে শিশুরাসহ এলাকার বাসিন্দারা। কারখানাটির মালিক ওই গ্রামের আবুল কালামের ছেলে আনোয়ার হোসেন। কারখানাটির সামনে দিয়ে পাকা রাস্তা এবং পেছন দিয়ে গেছে রেললাইন। কারখানার কাছেই কাকিনা রেলওয়ে স্টেশন। কারখানার ওই জায়গায় আগে ছিল চালকল। ছয় বছর আগে তামাক গুঁড়া করার কারখানা গড়ে তোলেন আনোয়ার হোসেন।

১০ এপ্রিল তালুক বানীনগর গ্রামে পৌঁছামাত্র ঝাঁজালো তামাকের গন্ধ পাওয়া গেল। গ্রামের শামীম হোসেন বলেন, ‘আমি গ্রামের ৪০০ পরিবারের স্বার্থে ২০১৮ সালের ১২ আগস্ট লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক বরাবরে কারখানাটি বন্ধ করার জন্য আবেদন করেছি। ওই বছরের ৯ অক্টোবর কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে অভিযোগের বিষয়ে শুনানি হয়। শুনানিতে আমি এবং অভিযুক্ত আনোয়ার হোসেন অংশ নেন। এরপর ৯ থেকে ২০ অক্টোবর কারখানাটি বন্ধ ছিল। পরে কারখানাটি আবার চালু হয়। কিন্তু আমরা কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না।’

শামীম হোসেনসহ আনোয়ার হোসেনের তামাক গুঁড়া করার কারখানাসংলগ্ন একাধিক বাড়িতে গিয়ে জানা গেল, এসব পরিবারের সদস্যদের শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ লেগে রয়েছে। গ্রামের বুলু মিয়ার স্ত্রী নাজমুন নাহার বলেন, তাঁর ছোট মেয়ের (দেড় বছর) প্রায় সময় শ্বাসকষ্ট, সর্দি, জ্বর এবং পেটের অসুখ লেগে রয়েছে। তাঁর নিজেরও মাথাব্যথাসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়েছে।’ রাজু মিয়ার স্ত্রী মণি বেগম বলেন, তাঁর আট মাস বয়সী ছেলের বুকের সমস্যা, কাশি, জ্বর ও সর্দি লেগেই থাকে। এ কারখানার কারণে তিনি তাঁর বড় ছেলে মোস্তাকিনকে (৪) তার নানাবাড়ি লালমনিরহাট শহরের বিডিআর হাট এলাকায় থাকার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন।

শামীম হোসেনের স্ত্রী সাজেদা আক্তার বলেন, সাত বছর আগে তাঁর বিয়ে হয়েছে এই এলাকায়। এখানে থাকলে তাঁর অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকে। অথচ বাবার বাড়ি পাটগ্রামে গেলেই তিনি সুস্থ হয়ে যান। শামীম হোসেন বলেন, তামাক গুঁড়া করার কারখানার সঙ্গেই তাঁদের বাড়ি। কারখানার মারাত্মক শব্দদূষণের শিকার হচ্ছেন তাঁরা। তিনি বলেন, ‘পারলে বাড়ি বিক্রি করে অন্য কোথাও চলে যেতাম, কিন্তু নরকের এই পরিবেশে আমাদের বাড়ি কে কিনবে বলেন।’

ওই কারখানার পাশেই অবস্থিত বেসরকারি সংস্থা ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) সমৃদ্ধি শিক্ষা সহায়ক কেন্দ্র। ওই কেন্দ্রের শিক্ষক নাজমুন নাহার বলেন, এখানে প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এই এলাকাসহ আশপাশের এলাকার বিভিন্ন স্কুলের শিশু শ্রেণি এবং প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির পিছিয়ে পড়া দুর্বল শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়া হয়। পাশে কারখানা থাকায় শিশুরা মাঝেমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাদের সর্দি, কাশি, জ্বর, পেটের অসুখসহ নানান সমস্যা দেখা দেয়। কারখানা চালু থাকার সময় শব্দ ও বায়ুদূষণ হয়। নাকে রুমাল দিয়ে পথ চলতে হয়।

তুষভান্ডার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুর ইসলাম আহমেদ বলেন, ‘তালুক বানীনগর গ্রামের তামাক গুঁড়া করার কারখানার জন্য গ্রামের পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে। আমি উপজেলা প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছিলাম, ইউএনও অফিসে শুনানি হয়েছে।’

কালীগঞ্জের ইউএনও রবিউল হাসান বলেন, তিনি এলাকাবাসীর লিখিত অভিযোগ পেয়ে অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত ব্যক্তির বক্তব্য শুনে বলেছিলেন, সব নিয়ম মেনে তামাক গুঁড়া করার কারখানা চালানো সম্ভব হলে চালানো যাবে, নইলে যাবে না। যেহেতু শুনানিতে উপস্থাপিত পরামর্শ মানা হয়নি, তাই আবারও অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

লালমনিরহাটের সিভিল সার্জন কাশেম আলী বলেন, আবাসিক এলাকায় কোনোভাবেই তামাক গুঁড়া করার কারখানা চালু রাখার আইনগত কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে বলে আশা করছেন তিনি।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ বলেন, যেকোনো কলকারখানা স্থাপনের আগে অবশ্যই পরিবেশ ও জনস্বার্থের বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে। আবাসিক এলাকায় তামাক গুঁড়া করার কারখানার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেবেন তিনি।

ওই কারখানার মালিক আনোয়ার হোসেন মুঠোফোনে প্রথম আলোর এ প্রতিনিধির পরিচয় পাওয়ার পর ‘ব্যস্ত আছি, পরে কথা বলেন’ বলে সংযোগ কেটে দেন। পরে কয়েকবার ফোন দিলে তিনি আর ফোন ধরেননি।