অবেদনবিদ নেই, প্রসূতি অস্ত্রোপচার বন্ধ তিন মাস

চিকিৎসক ও চিকিৎসা সরঞ্জামের সংকটে নীলফামারীর ডোমার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। অবেদনবিদ না থাকায় তিন মাস ধরে এখানে প্রসূতি অস্ত্রোপচার বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া শয্যাসংকটের কারণে অনেক রোগীকে মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

গতকাল বুধবার দুপুর ১২টার দিকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি বিভাগের সামনের বারান্দার বেঞ্চে বসে ও শুয়েছিলেন কয়েকজন রোগী ও তাঁদের স্বজনেরা। এ সময় কথা হয় উপজেলার পাঙ্গামটুকপুর ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া থেকে আসা লিপি বেগমের (৩০) সঙ্গে। সেখানে শুয়ে ছিলেন তাঁর শাশুড়ি রাজিফা বেগম (৬০)। লিপি বেগম বলেন, ‘আমার শাশুড়ির রাত থেকে প্রেশার লো (রক্তচাপ কমে গেছে)। তিনি বমিও করছেন। বেলা ১১টা থেকে বসে আছি, চিকিৎসক নেই। চিকিৎসক এলে শাশুড়িকে দেখিয়ে ভর্তি করাব।’ একই কারণে অন্যরাও বসে অপেক্ষা করছেন বলে জানান তাঁরা।

জরুরি বিভাগে দায়িত্ব পালন করছিলেন উপসহকারী কমিউনিটি চিকিৎসা কর্মকর্তা শামিমা আক্তার। তিনি বলেন, ‘জরুরি বিভাগে আরেকজন চিকিৎসক আছেন। তিনি স্বাস্থ্য বিভাগের সেবা সপ্তাহের সভায় আছেন। আমি ওনার নাম জানি না।’
দ্বিতীয় তলার মহিলা ও পুরুষ ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, বিছানা ও মেঝেতে ঠাঁই নিয়ে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন সাত-আটজন রোগী। তবে ওয়ার্ডগুলো মোটামুটি পরিচ্ছন্ন।
মহিলা ওয়ার্ডে কথা হয় গোমনাতি বাজার গ্রামের রাজিমা বেগমের (৩৫) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রাত থেকে শ্বাসকষ্ট ও বুকে ব্যথা হচ্ছে। সকাল ১০টার দিকে
ভর্তি হয়েছি। বিছানা নেই, এ জন্য মেঝেতে জায়গা নিয়েছি। এখানে ওষুধ ও ইনজেকশন দিয়েছে।

ইসিজি করতে বলেছে। হাসপাতালের বাইরে গিয়ে ২০০ টাকা দিয়ে ইসিজি করেছি।’ হাসপাতালে ইসিজি না করার কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘শুনলাম হাসপাতালের মেশিন নাকি ভালো না, এ জন্য বাইরে করেছি।’
সাত মাস বয়সী মেয়ে মোসলেমাকে নিয়ে শেফালী বেগম (৩০) নামে এক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হলেও শয্যা পাননি। তিনি তাঁরে মেয়েকে নিয়ে মেঝেতে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মা-মেয়ে দুজনেই শ্বাসকষ্ট ও বুকের ব্যথা নিয়ে ভর্তি হয়েছি। কিন্তু বিছানা না থাকায় মেঝেতে থাকতে হচ্ছে।’

দুপুর ১২টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত কোনো ওয়ার্ডে চিকিৎসকের দেখা পাওয়া যায়নি। রোগীরা জানান, সকালে একবার চিকিৎসক এসে গেছেন।
দুই ওয়ার্ডের কর্তব্যরত নার্সরা জানান, ৫০ শয্যার এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত মহিলা ওয়ার্ডে ২৭ জন ও পুরুষ ওয়ার্ডে ২৩ জন রোগী ভর্তি ছিল। ৫০ শয্যার হলেও এখানে গতকাল ৩৬টি শয্যা ব্যবহারের উপযোগী ছিল। এ দুই ওয়ার্ডে সাতজন নার্স কর্মরত থাকার কথা। তবে গতকাল তাদের মধ্যে তিনজন স্বাস্থ্য বিভাগের সেবা সপ্তাহের সভায় ছিলেন।
বহির্বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মোয়াজ্জেম হোসেন ও গাইনি বিশেষজ্ঞ ওবায়দা নাসরিন রোগী দেখছেন।
গাইনি বিশেষজ্ঞ ওবায়দা নাসরিন বলেন, ‘গতকাল সেবা সপ্তাহের কর্মসূচি পালনের কারণে রোগী দেখতে পারিনি। এ কারণে আজ সভায় যাইনি, রোগী দেখছি।’
বিশেষজ্ঞ মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, রোগীর চাপ থাকায় তিনিও সেবা সপ্তাহের সভায় যাননি।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিসংখ্যানবিদ লায়লা ইয়াসমিন চৌধুরী জানান, এখানে চিকিৎসকের ২১টি পদের মধ্যে ১৩টি পদই শূন্য। সে হিসেবে আটজন থাকার কথা। তবে গতকাল কর্মরত ছিলেন পাঁচজন। ওই আটজনের মধ্যে রেজাউল আলম নামে একজন চিকিৎসক প্রেষণে আছেন নীলফামারী সদর হাসপাতালে। শওকত আলী সাফায়াত নামে আরেকজন চিকিৎসক অনুপস্থিত আছেন ২০১০ সাল থেকে। চলতি মাসের ৩ ও ৭ তারিখে দুজন চিকিৎসক এখানে যোগদান করেছেন। তবে তাঁদের মধ্যে একজন এখন ছুটিতে আছেন।

লায়লা ইয়াসমিন চৌধুরী আরও জানান, ২০১৫ সাল থেকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক্স-রে যন্ত্র বন্ধ আছে। ২০১৭ সালে আলট্রাসনোগ্রাম যন্ত্র এলেও ত্রুটির কারণে চালু করা সম্ভব হয়নি। অ্যানেসথেসিয়া ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ না থাকায় প্রসূতিদের সিজার বন্ধ আছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. মেহেফুজ আলী বলেন, ‘জরুরি বিভাগে তিনজন চিকিৎসক প্রয়োজন। সেখানে আমার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা কর্মকর্তা আছেন তিনজন। ইসিজি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হয়। আলট্রাসনোগ্রাম ও এক্স-রে মেশিন আমি এখানে যোগদানের অনেক আগে থেকে বিকল। অবেদনবিদ গত জানুয়ারি মাসে বদলি হওয়ায় সিজার বন্ধ রয়েছে। বিষয়গুলো আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।’
ডোমার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ও সরঞ্জাম সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে নীলফামারী সিভিল সার্জন রণজিৎ কুমার বর্মণ প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিকিৎসক–সংকটের কথা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। চলতি মাসে সেখানে (ডোমার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স) দুজন চিকিৎসক দেওয়া হয়েছে।